নানা বয়সী শ্রেণিপেশার মহিলারা সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন। প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের বাসা-অফিসে গিয়েও মনোনয়ন পাওয়ার নিশ্চয়তার জন্য অনুরোধ করছেন কেউ কেউ। এমনকি দলীয় প্রধানের নজর কাড়তে সুন্দর সুন্দর ব্যানার ফেস্টুনেও অনেকেই ছেয়ে ফেলেছেন ধানমন্ডি ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের রাজনৈতিক কার্যালয়ের আশপাশের এলাকা। অবশ্য এসবকে ছাপিয়ে দলের ত্যাগী ও রাজপথের পরীক্ষিত নেত্রীদের মূল্যায়নের চিন্তাভাবনা করছে আওয়ামী লীগ।
দলীয় সূত্র বলছে, অতীতের মতো এবারো তৃণমূল থেকে নতুনদের সুযোগ করে দেয়া হবে। তারই ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনে বেশির ভাগ নতুন মুখ আসছে। এ ক্ষেত্রে সংগঠনের ত্যাগী, বঞ্চিত, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী নারী নেত্রীদের প্রাধান্য দেয়া হতে পারে। এ ছাড়া বিগত সময়ে যেসব জেলা বঞ্চিত হয়েছে সেসব জেলাকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি পর্যালোচনায় রয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেত্রীদের কয়েকজন সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পেতে পারেন- এমন আভাস মিলেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের মনোনয়ন দেবে আওয়ামী লীগ। আমাদের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের পর থেকেই পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। জেলা সফরে গিয়েও যোগ্য কাউকে দেখলে তার নাম লিখে রাখেন। সময়মতো সেটি কাজে লাগান। এ ছাড়াও সংস্কৃতি অঙ্গনের কেউ কেউ মনোনয়ন পেতে পারেন বলে আভাস দিয়ে রেখেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে দলের ত্যাগী, যোগ্য, দক্ষ ও পরীক্ষিত নেত্রীদের মূল্যায়ন করার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, মনোনয়নের ক্ষেত্রে সবসময়ই দলের সক্রিয়, ত্যাগী, যোগ্য ও পরীক্ষিতদের মূল্যায়ন করা হয়। এবার তার ব্যতিক্রম হবে না।
অতীতের মনোনয়ন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের একটা বড় অংশ মনোনয়ন পান পরিবারের অবদানের কারণে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ পরিবারকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ওই পরিবারের দাদা, নানা, পিতা, স্বামী বা ভাইয়ের ত্যাগকে বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়। ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও এমন পরিবারের নারী সদস্যদের কেউ কেউ জায়গা পাবেন। এর বাইরে ব্যক্তির ত্যাগকেও বিশেষভাবে মূল্যায়ন করার কথা ভাবছে দলটির নীতিনির্ধারণী মহল। তাদের মতে, তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যন্ত যাদের পরিবারের কোনো ব্যক্তির দলের প্রতি ত্যাগ না থাকলেও মনোনয়নপ্রত্যাশী ব্যক্তির দলের জন্য ত্যাগের বিষয়টা এবার বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হবে। গত ১৫ বছর যারা রাজপথে বিভিন্ন সময় সক্রিয় থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং অতীতে বিরোধী দলে থেকে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন কিন্তু এ পর্যন্ত মূল্যায়নের ঝুড়িতে শূন্য রয়েছেন তাদেরকেও এবার মূল্যায়নের চিন্তা করা হচ্ছে।
দলের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবরই নতুন ও বঞ্চিতদের মূল্যায়ন করে থাকেন। এবারো সংরক্ষিত আসনে তার প্রতিফলন দেখা যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনগুলোতে কাদের কাদের আনা যায়, সেটির বিষয়ে একটা বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছেন। তিনি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ব্যক্তিগত সোর্স দিয়ে ক্লিন ইমেজের ত্যাগী ও যোগ্য নেত্রীদের একটি তালিকা সংগ্রহ করে রেখেছেন।
গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার টানা তিন দিন দলীয়ভাবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা নেয়া হয়েছে। ৪৮টি সংরক্ষিত আসনের বিপরীতে এবার মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে এক হাজার ৫৪৯টি। এগুলো প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের কাজও শেষ হয়েছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বুধবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে আওয়ামী লীগের ওই সব মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হবে। ওই দিনই সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের এক সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভায় স্বতন্ত্র এমপিদের ছেড়ে দেয়া আসনসহ ৫০ সংরক্ষিত মহিলা আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের পাওয়া ৪৮টি আসনে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই আসনের মধ্যে দু’টি আসন জোটের শরিকদের ছেড়ে দেয়া হতে পারে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত মহিলা এমপি ছিলেন ৪৩ জন। এর মধ্যে খাদিজাতুল আনোয়ার, রুমানা আলী ও সুলতানা নাদিরা দলের মনোনয়নে এবং তাহমিনা বেগম স্বতন্ত্র ভোট করে এবার সরাসরি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ৩৯ জনের মধ্যে হাতেগোনা দুই-একজন ছাড়া বেশির ভাগই এবার বাদ পড়বেন বলে জানা গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান, অ্যারোমা দত্তসহ হাতেগোনা কয়েকজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাপা, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা: রোকেয়া সুলতানা, কার্যনির্বাহি সদস্য মারুফা আক্তার পপি ও পারভীন জামান কল্পনা, যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি নাজমা আকতার, সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি তারানা হালিম, মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, মাহাবুব আরা গিনি, মহিলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদিকা কাজী রহিমা আক্তার সাথী, যুব লীগের সাবেক নেত্রী শেফালী, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাসহ অন্তত শতাধিক নারী নেত্রী এমপি হওয়ার দৌড়ে আলোচনায় রয়েছেন। এ দিকে কেন্দ্রীয় নেতা ও সহযোগী সংগঠনের সাবেক প্রভাবশালী দুয়েকজন নেতা-মন্ত্রীর স্ত্রীও সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি হওয়ার দৌড়ে বিশেষভাবে আলোচনায় থেকে এগিয়ে রয়েছেন।