আজ পৌষ মাসের ১৩ তারিখ। দেখতে দেখতে এসে যাবে পৌষসংক্রান্তি-পিঠা-পুলির উৎসব। আনন্দে মেতে উঠবে বাংলার মানুষ। কিছু দিন আগেই উঠেছে আমাদের এক নম্বর ধানী ফসল-আমন। কৃষক নবান্ন করেছে। খবর, অগ্রহায়ণী বা আমন ধানের ফলন হয়েছে মোটামুটি ভালো, যা অন্যান্যবার হয় বাম্পার। কৃষাণ-কৃষাণী কাটিয়েছেন ব্যস্ত সময়। আজকাল আবার যন্ত্র ব্যবহার হয় ফসল তুলতে। যন্ত্র সরবরাহকারীরা করেছে ব্যবসা। ব্যস্ততা শেষ হতে না হতেই কৃষকরা তুলেছেন আরেক ফসল-পাট, আমাদের সোনালি আঁশ। অন্তত আমরা ছোটবেলায় তা-ই পড়েছি। দেশে বেসরকারি খাতে প্রচুর পাটকল আছে। তাদের চাহিদা মিটিয়েও পাট রপ্তানি হয়। এবার পাটের বাজার, রপ্তানি বাজার মন্দা। এটা প্রায়ই হয়। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি পাট কৃষকের মাথার বোঝা। কখনো উচিত দাম পান, কখনো পান না। পয়সা বানায় গ্রামীণ ফড়িয়া-মহাজনরা। দরিদ্র কৃষক যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই থাকে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়েছে। পাকিস্তান আমলের গেছে ২৪ বছর। পাটের উচিতমূল্যের সমস্যা ৬০-৭০ বছর আগে ছিল, এখনো তা-ই আছে। ধানের দামের কী অবস্থা। এখন ভরা মৌসুম। খেয়ে-পরে আরাম করার সময়। নতুন ধান, পাটের গন্ধ, খেতে সবজি। বিলে-খালে মাছ। কই, শিং, মাগুর, বোয়াল, কাতল, রুই, সরপুঁটি, আরও কত রকমের মাছ। সবুজ সবজি খেত ভর্তি। খেয়ে-পরে আনন্দ পাওয়ার সময় এখনই। কিন্তু বিধি বাম! ভরা মৌসুমেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে অহেতুক। সরকারের হাতে চাল আছে। কৃষকের ঘরে চাল আছে। বাজারে চাল আছে। সরকার চাল আমদানি করছে। তবু চালের দাম বাড়তি। এক কাগজে দেখলাম, দিনাজপুরে ‘বি-আর ২৯’ নামের এক ধরনের চালের কেজি ৬৪ টাকা। ‘বি-আর ২৮’ ৬৫ টাকা। মিনিকেট ৭৪-৭৬ টাকা। স্বর্ণা অবশ্য ৫২-৫৬ টাকা। বেড়েছে কত? ৩-৪ টাকা। অসম্ভব কাণ্ড। মিলাররা একযোগ হয়ে চালের দাম প্রতিবছর মৌসুমের সময়ই বাড়ায়। বোকা বনে থাকে ক্রেতারা। মিডিয়া ফলাও করে এসব লেখে। লিখলে কী হবে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
এরই মধ্যে বোরো চাষের কাজ চলছে। বোরোর চারা কৃষকরা তুলছেন বীজতলা তৈরির জন্য। চারার দামও বেড়েছে। চারা উৎপাদনে খরচ বেড়েছে বলে খবর। সারা দেশে এ পৌষ মাসেই বোরোর চাষ আরম্ভ হয়। কৃষকের ব্যস্ত সময়। মজুর পাওয়া যায় না। ঢাকার রিকশাওয়ালাদের অনেকেই দেশের বাড়িতে যাচ্ছেন। এ সময়ে গ্রামে শ্রমের দাম একটু বাড়ে। ওই বাড়তি মজুরির আশায়ই তারা বাড়ি যাচ্ছেন। বস্তুত এ সময়ে দেশের এক অঞ্চলের শ্রমিক আরেক অঞ্চলে যান-শ্রমিক অভিবাসন। অভ্যন্তরীণ শ্রমিক অভিবাসন আর কী! এতে শ্রমিকের দুটি পয়সা আসে। শুধু শ্রমিক নয়; এখনকার সময়ে বোরো চাষে কৃষি যন্ত্রপাতি কাজে লাগছে। বলা হচ্ছে, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। সরকার কোটি কোটি টাকা কৃষির যান্ত্রিকীকরণে খরচ করে এখন। এর ফলও আমরা পাচ্ছি। বোরো এখন আমাদের এক নম্বর ধানী ফসল। এক সময় ছিল আমন ধান। এখন আর তা নেই। বোরো, আমন ও আউশের মধ্যে বোরোই এখন এক নম্বর ফসল। এই বোরোর কল্যাণেই আমাদের ধানের ফলন স্বাধীনতার পর প্রায় চারগুণ হয়েছে। লোকসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। তবু খাদ্যাভাব-আমদানি করতে হয় খাদ্যশস্য। কোথায় গোমর কেউ জানে না। বোরো ফলনে বহু কৃষি উপকরণ লাগে। বাজারের খবর, প্রতিটি উপকরণের দাম ঊর্ধ্বমুখী। অথচ এর অর্থায়ন নেই। এবার শোনা যাচ্ছে, কৃষিঋণের ঘাটতি চলছে। বস্তুত গ্রামের ব্যাংক শাখায় ক্যাশের ঘাটতি। বাইরের রেমিট্যান্স যা আসে, তার টাকা খুব বেশি কৃষিতে লাগে না। রেমিট্যান্সের ‘বেনিফিশিয়ারিরা’ কৃষি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বলে খবর। ঘটনাও তাই। কৃষির উৎপাদনশীলতা যেমন কমছে, তেমনি কৃষিতে বিনিয়োগও নেই। বেসরকারি খাত কৃষিতে বিনিয়োগ করে না। সরকারি বিনিয়োগও কম। কৃষকরা, বড় বড় কৃষকদের ছেলেরা কৃষিতে যাচ্ছেন না। তারা একে অসম্মানজনক পেশা মনে করেন। অধিকন্তু কৃষি অলাভজনক। কৃষকরা উপায়ান্তর না দেখে এ পেশায় নিয়োজিত।
এবার বোরো ফসল উৎপাদনের কাজটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। চালের ঘাটতি হোক, তা কেউ চায় না। এদিকে নতুন পেঁয়াজ ও আলু উঠেছে। কিন্তু মানুষের আশায় জল পড়েছে। এ সময়ে ফসল ওঠার পর আলু ও পেঁয়াজের দাম কমে। মানুষ একটু স্বস্তি পায়। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। নতুন আলু ওঠার পরও আলুর কেজি এখনো ৮০-৯০ টাকা। এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। কারণ আমরা সবসময় বলে আসছি, আলুতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই, বরং উদ্বৃত্ত। একবার কিছু আলু আমরা রপ্তানিও করেছি। আলু খাওয়ার জন্য একবার গানও বাঁধা হয়েছিল। এটা বেশিদিন আগের কথা নয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের ঘটনা। কী এমন ঘটল যে এখন আমাদের আলু আমদানি করতে হয়? নতুন আলু কিনতে হয় ৮০-৯০ টাকা কেজি দরে। বলা হচ্ছে ‘সিন্ডিকেটের’ কথা। এখন বলা হচ্ছে চাঁদাবাজির কথা। এ চাঁদাবাজি কবে শেষ হবে? না, তার আশা নেই। কারণ এখন বলা হচ্ছে, চাঁদাবাজি ঠিকই আছে-লোক বদল হয়েছে মাত্র। শুধু আলু নয়, একই কথা পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও। বস্তুত ২০২৪ সালের পুরোটাই গেছে সয়াবিন, আলু ও পেঁয়াজের ‘গীত’ গেয়ে।
এসব দুঃখের মধ্যেও কৃষক বসে নেই। গ্রামে গ্রামে, বিশেষ করে সিলেট, কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে; কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা ইত্যাদি অঞ্চলে কৃষকরা ব্যস্ত শুঁটকি তৈরিতে। এখন শীতকাল। প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। উদ্বৃত্ত মাছ শুকিয়ে কৃষকরা এ সময়েই শুঁটকি মাছ তৈরি করেন। কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হাজার হাজার কৃষক/জেলে এখন মাছ শুকানোর কাজে ব্যস্ত। হাজার হাজার মাটির ‘মটকি’ বিক্রি হচ্ছে। শুঁটকি এখন হেলাফেলার জিনিস নয়। কেজি বিক্রি হয় ৮০০-১২০০ টাকায়। বস্তুত শুঁটকি এখন বিদেশেও রপ্তানি হয়। ভালো দাম পাওয়া যায়। শুঁটকিতে প্রতিবছর ব্যবসাও ভালো হয়। ৫০০-১০০০ কোটি টাকার বাণিজ্য শুঁটকিতে হয় বলে ধারণা।
এদিকে যথারীতি চলছে ফুলের চাষ। যশোরের গদখালীতে হাজার হাজার ফুলচাষি, ব্যবসায়ী বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন। ডিসেম্বরে ফুলের চাহিদা থাকে। বিজয় দিবস, বড়দিন, নববর্ষ ইত্যাদির অনুষ্ঠানে ফুলের চাহিদা বাড়ে। সামনে বর্ষবরণ, ফেব্রুয়ারি মাস, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা নববর্ষ-তাই প্রচুর চাহিদা। শোনা যাচ্ছে, এবার ফুল চাষিরা ১০০০ কোটি টাকার ব্যবসা করবেন। এ মন্দার বাজারে দারুণ খবর নয় কি!
এদিকে বরাবর দেশে যখন এ সময়ে জিনিসপত্রের দাম কমে-চাল, ডাল, লবণ, তেল, শাকসবজি, মাছ-মাংসের দামে একটা স্বস্তি মেলে-তখন এবারের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। মূল্যস্ফীতি সরকারি হিসাবেই ১০ শতাংশের বেশি। মানুষ কষ্টে আছে, কিন্তু বোকা বনে আছে। সব ক্ষেত্রে মন্দা চলছে। শিল্পে মন্দা। বহু শিল্প বন্ধ হয়ে আছে। কয়েকদিন আগে একটি শিল্পে ‘লে-অফ’ ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ৪০ হাজার শ্রমিক এতে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেক শিল্পের মালিক দেশছাড়া। তারা নিয়মিত ব্যবসা করছেন না। গ্যাসের অভাব রয়েছে। বিদ্যুতের অভাব রয়েছে। ডলারের অভাবে তারা ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। অথচ সামনে পবিত্র ঈদ। এখনই ঋণপত্র খোলার সময়। চাল, ডাল, তেল, সয়াবিন, পেঁয়াজ, রসুন, লবণ, চিনি ইত্যাদি আমদানির জন্য লাগবে অনেক ডলার। অথচ ডলার নেই। আবার যেভাবেই হোক, রমজান মাসের চাহিদা মেটাতে হবে। আগের ‘ওভার ডিউ’ এলসির টাকা পরিশোধ এবং রমজানের পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার জোগাতে ব্যাংকগুলো নাস্তানাবুদ। ডলারের দাম খোলাবাজারে ১৩০ টাকায় উঠেছে বলে কাগজে দেখলাম। এটা হলে বিপদ। এমনিতেই দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী, তার ওপর ডলারের দামের আরও বৃদ্ধি আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে নিশ্চিতভাবেই। এদিকে রয়েছে সুদের টাকা পরিশোধের চাপ। রয়েছে রাজস্বের চাপ। সরকারি রাজস্ব বছরে সাধারণত ১০-১৫ শতাংশ বাড়ে বলে প্রচার করা হয়। এবার বিষয়টি এরকম নয়। অনুমান, আশানুরূপ রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ব্যাংকের তারল্যও নেই। লোকের হাতে টাকা নেই। যে টাকা আছে, তা বাজার খরচায় যাচ্ছে। এরপর যা থাকে, তা ব্যাংকে না রেখে লোকে নিজের হাতেই রেখে দিচ্ছে। অনিশ্চয়তা। তারপর ইসলামী ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা, যারা সব টাকা খেয়ে বসে আছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদে আছে গ্রামের লোকেরা। তারাই ইসলামী ব্যাংকের বড় গ্রাহক। ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে না পারায় মানুষের হাতে টাকা নেই। ছোটখাটো লেনদেনে পর্যন্ত অসুবিধা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে না পারায় বাজারে অনেক জিনিসের প্রাপ্যতা নেই।
এ মুহূর্তে বাজারে সবচেয়ে বড় অভাব সয়াবিন তেলের। লিটারে ৮ টাকা একলাফে দাম বাড়ানোর পরও বাজারে সয়াবিন পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন সরকার খরচ কমিয়েছে। বাজে প্রকল্পগুলো বাদ দিয়েছে। ব্যাংকিংয়ে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। হরেদরে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। ঋণের ওপর সুদ বাড়ছে। কিন্তু তবু মূল্যস্ফীতি কমছে না। আইএমএফ আসছে কয়েকদিনের মধ্যেই। তারা তাদের প্রতিশ্রুত টাকা দেবে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও বাজেট সাপোর্টের নামে টাকা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু কোনো টাকাই হাতে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার নতুন বাজেটের কাজ শুরু করেছে। ছোট বাজেট হবে। এদিকে আবার সরকারি কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ্য ভাতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ বাজারে মহার্ঘ্য ভাতার ফলাফল কী হবে? বেসরকারি খাতের কর্মচারীদের কী হবে? নানা চিন্তা। এদিকে আইএমএফ বলছে, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি স্লথ হয়ে পড়েছে।’ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। কোনোভাবেই ভালো সংবাদ নয়।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়