কোটি মানুষের বসবাসের রাজধানী ঢাকা শহরের পদে পদে ওঁৎ পেতে আছে মৃত্যু। প্রয়োজনীয় আইন থাকলেও ঢাকার বাসিন্দাদের কতটা নিরাপত্তা দিতে পারছে সেই আইন?
এই নগরীতে মৃত্যু যেন পায়ে পায়ে। কখন কে অপঘাতে মারা যায় কেউ বলতে পারে না। কখন কে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে বলা যায় না। ঘরে বিপদ, বাইরে বিপদ। বাতাসে বিপদ, বিপদ আকাশেও।
মানুষকে রক্ষার আইন আছে। কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে সেই আইন কতটা কাজে আসছে সেই প্রশ্ন থেকে যায়। ঢাকায় আগুনের ঘটনায় প্রায়ই মৃত্যু হয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা। গ্যাস লাইন, সুয়ারেজ লাইন, ওয়াসার পানির লাইন সব লাইনই যেন বিস্ফোরণের কারখানা হয়ে উঠছে।
রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, রয়েছে নীরব ঘাতক দূষিত বায়ু। নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে ইট পড়ে কখন যে কার প্রাণ যায়, বলা যায় না। আবার নির্মাণশ্রমিকও উঁচু ভবন থেকে পড়ে জীবন হারায়। এই নগরী তাই যেন এখন এক মৃত্যুকূপ।
বাসাবাড়িতে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার, যানবাহনে গ্যাস সিলিন্ডার ফাটছে- যাচ্ছে জীবন। কোথায় আছে নিরাপত্তা?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন জায়গায় অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনা বলতে গেলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর আইনের শাসনের অভাবে নাগরিকদের মধ্যেও আইন না মানার প্রবণতা বাড়ছে। সবাই সবকিছু ‘ম্যানেজ‘ করে চালাচ্ছে। ম্যানেজের মাধ্যমে সব অনিয়ম ও দুর্নীতি চাপা পড়ে যাচ্ছে। যার বলি হচ্ছে সবাই।
যত মৃত্যুফাঁদ
সিদ্দিকবাজারের মার্কেটে বিস্ফোরণের কারণ হলো বেসমেন্টে অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ গ্যাস লাইন। জীবন গেল ২৪ জনের। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে সুয়ারেজ লাইনের গ্যাস থেকে। নিহত হয়েছে পাঁচ জন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা ওয়াসার পানির লাইন থেকেও হতে পারে। ওয়াসার লাইনে যে পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা জমে তা থেকেও গ্যাস হয়ে বিস্ফোরণ হতে পারে।
রাজধানীর সড়কগুলোতে দেখা যায় বিদ্যুৎ লাইনের খুঁটির সাথে বিভিন্ন ধরনের তারের জঞ্জাল। প্রায়ই ওই সব তারের জঞ্জাল থেকে আগুন ধরে যায়।
আর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনা তো ঘটছেই। বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গত বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছে তাদের প্রায় ২৭ ভাগ ঢাকায়।
গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে মোট নিহত হয়েছে সাত হাজার ৭১৩ জন। এর মধ্যে ঢাকায় নিহত হয়েছে দুই হাজার ৪৪ জন। দুর্ঘটনা আর মৃত্যু দুটিতেই ঢাকা শীর্ষে।
ফায়ার সার্ভিসের হিসাব মতে, ২০২২ সালে সারাদেশে মোট অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ২৪ হাজার ১০২টি। এর মধ্যে বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ড ৯৪টি, গ্যাস সরবরাহ লাইনে আগুন লেগেছে ৭৯৫টি। গ্যাস সিলিন্ডারে অগ্নিকণ্ডে ৩০ জন আহত হয়েছে এবং একজন নিহত হয়েছে।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (আরপিজিসিএল) তথ্যমতে, গত বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে পাঁচ লাখ সাত হাজার গাড়ি সিএনজিতে রূপান্তর করা হয়েছে। রান্নার কাজে দেশে এখন প্রায় সাড়ে তিন কোটির বেশি এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসাবাড়ি ছাড়াও পরিবহনে ও ক্ষুদ্র শিল্পের জ্বালানি হিসেবে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে অনেকেই। এই দুই খাতের বাইরে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাসের সিলিন্ডার রয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো।
যানবাহনে দুর্ঘটনার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার দায়ী। যানবাহনের প্রায় ৮০ ভাগ সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা ছাড়াই চলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন দেশে দেড় থেকে দুই লাখ মানহীন সিলিন্ডারযুক্ত গাড়ি চলছে রাস্তায়। আর এইসব ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা।
জানা গেছে, যেসব পাইপলাইনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকায় মানুষের বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়, সেসব পাইপলাইনের মেয়াদ ছিল ৩০ বছর। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ বছর পরও ওইসব পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রায়ই গ্যাসের সরবরাহ লাইনে লিকেজ পাওয়া যাচ্ছে, যা বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে।
বায়ু দূষনে ঢাকা প্রায়ই পৃথিবীর শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষে উঠে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিবছর বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আর এর বড় অংশটি হলো ঢাকায়। ঢাকার বায়ুদূষনের প্রধান কারণ হলো যানবাহনের ধোঁয়া, শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো নির্মাণ এবং মেরামতের কারণে সৃষ্ট ধুলিকণা। ঢাকার বাতাসে এখন লেড ও মার্কারির মতো হেভি মেটালের উপস্থিতিও পাওয়া যাচ্ছে গবেষণায়।
যে কারণে মৃত্যুকূপ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকা শহর এমন মৃত্যুকূপ হওয়ার কারণগুলোর একটি হলে প্রত্যেকটি পরিকল্পনার সাথেই নিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকতে হয়, সেটা আমরা করিনি। আমরা বিভিন্ন কারণে সঠিক পরিকল্পনা করিনি বা ছাড় দিয়েছি। আরেকটি হলো সুশাসনের অভাব। এই তিতাস, রাজউক, ওয়াসা, পুলিশ, বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদফতরে যাদের যা দায়িত্ব তারা তা পালন করছে না। আর হচ্ছে আইনের শাসনের অভাব। কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয় না। হলেও ছাড়া পেয়ে যায়। ফলে ঢাকা শহরের পুরো সিস্টেম কলাপস করেছে।’
তার প্রশ্ন, যেদেশে পরিবহন মালিক- শ্রমিকদের চাপের মুখে নিরাপদ সড়ক আইন কার্যকর করা যায় না সেই দেশের সড়ক নিরাপদ হবে কিভাবে? যেখানে উৎকোচের বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অবৈধ লাইন নেয়া যায় সেই দেশে অপঘাতে মৃত্যু কমবে কিভাবে?
তার মতে, নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে। কিন্তু দুর্নীতি, অনিয়ম ও ম্যানেজ ব্যবস্থা দেখে নাগরিকেরাও ওই প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
প্রয়োজন সঠিক জায়গায় সঠিক লোক
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী মনে করেন, ‘সঠিক জায়গায় সঠিক লোক নেই। রাজউকের যেসব নিয়ম-কানুন আছে সেটা বাস্তবায়নের জন্য ফিল্ড লেভেলের জ্ঞান সম্পন্ন কর্মকর্তা নেই। দুর্নীতি তো আছে, সেটা একটা ব্যাপার। কিন্তু যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদের যদি সেই সংক্রান্ত জ্ঞানই না থাকে তাহলে হবে কিভাবে? এখন বিআরটিএ চালকদের লাইসেন্স ও ডোপ টেস্টের জন্য প্রাইভেট সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের কাজ করতে দিচ্ছে। এটায় ফল আসবে বলে আমি আশা করি। কিন্তু রাস্তা, ট্রাফিক সিস্টেম- তার কী হবে? আমরা কী করতে চাই, কিভাবে করতে চাই সেটাই ঠিকমতো জানি না।’
তার মতে, ম্যানেজমেন্ট হলো আসল। আমাদের সঠিক ম্যানেজমেন্ট নাই। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আইন যথেষ্ঠ আছে। কিন্তু সেটাতো কাগজে। বাস্তবায়ন কে করবে?
তার কথা, এখনো ঢাকা শহরের যে পরিস্থিতি সঠিক ব্যবস্থাপনায় গেলে সেটা সামাল দেয়া সম্ভব। যারা আছেন তাদের দিয়ে হবে না। তাই সঠিক লোক প্রয়োজন।
সূত্র : ডয়চে ভেলে