১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর টাকা কামানোর নেশায় পেয়ে বসে আব্দুর রহমানকে। পরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে ধাপে ধাপে দলের সভাপতিম-লীর সদস্য হন। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী, মধুখালী ও আলফাডাঙ্গা) আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর থেকে অঢেল সম্পত্তির মালিক হতে থাকেন দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া আব্দুর রহমান। পরের দুটি নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী হন।
গত কয়েক বছর এমপি-মন্ত্রী হয়ে দুই হাতে কামিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। শুধু নিজের নামে নয়, স্ত্রী-সন্তান, এমনকি মেয়েজামাইয়ের নামেও কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হয়েছেন আব্দুর রহমান।
আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে তার নিজ এলাকায় রয়েছে অজস্র অভিযোগ। জায়গা দখল, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানি, বিভিন্ন কাজ থেকে পার্সেন্টেজ, মনোনয়নবাণিজ্য, চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া, দলে পদ দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ছাড়াও নারী কেলেঙ্কারিরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে বাগিয়ে নেন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট। দেশে অঢেল সম্পদ থাকার পাশাপাশি বিশ্বের ৫টি দেশে তার বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এলাকায় আব্দুর রহমানকে নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত ছিল যে, টাকা ছাড়া আব্দুর রহমান এক পা-ও চলেন না। ঢাকা থেকে তার নিজ এলাকায় আসার পথে ফেরিতে ওঠা কিংবা পদ্মাসেতু পার হওয়ার আগেই স্থানীয় নেতাদের ফোন করে টাকা রেডি রাখার কথা বলতেন। শেখ হাসিনার পতনের পর আব্দুর রহমানের নানা দুর্নীতি আর কুকীর্তির কথা শুনে অনেকের পিলে চমকে ওঠে।
আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎপূর্বক নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে অজ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও শোনা যায় তিনি ৫ আগস্টের পরপরই দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামায় আব্দুর রহমান তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ২৮ লাখ ১১ হাজার টাকা। আর নিজের নামে কামালদিয়ায় একটি বাড়ি থাকার কথা উল্লেখ করলেও তার স্ত্রীর নামে ঢাকায় চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। অথচ স্থানীয় মুরব্বিরা জানান, আব্দুর রহমানের বাবা মারা যাওয়ার সময় মাত্র ১৪ শতাংশ জমি রেখে যান।
এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ফরিদপুর-১ আসনের তিনটি উপজেলায় একচ্ছত্র ‘রামরাজত্ব’ কায়েম করেন আব্দুর রহমান। তার বিরুদ্ধে রয়েছে দখলদারির অভিযোগ। নিজ নামে এবং ছেলে-মেয়ের নামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ব্রাহ্মণকান্দায় ‘আব্দুর রহমান কলেজ’ ও ‘আয়েশা-সামি’ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারি জায়গা দখল করে সেই জায়গা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কলেজের নামে করে নেন। কাদিরদি এলাকায় সরকারি অর্থায়নে গড়ে তোলা একটি কারিগরি কলেজের নাম তার মা ও বাবার নামে করার চেষ্টা চালান।
মধুখালী, বোয়ালমারীতে নিজ নামে ছাড়াও ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর নামে প্রভাব খাটিয়ে বেশি দামের জমি কম দামে কেনার অভিযোগ রয়েছে। সাতৈর এলাকায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে স্ত্রী নাহিদ ইসলাম বর্না ও মেয়ের জামাতা জুবের নিলয়ের নামে একটি স্বয়ংক্রিয় ইটভাটা (রাজ সিরামিক ব্রিকস) নির্মাণের জন্য জমি হাতিয়ে নেওয়া হয়।
তিনটি উপজেলায় আব্দুর রহমানের বিশেষ বাহিনী ছিল। এসব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা। হামলা করে, মামলা দিয়ে বিরোধীপক্ষের নেতাকর্মীদের এলাকাছাড়া করতে বাধ্য করেন। শুধু বিরোধী নয়, তার বিপক্ষে গেলে নিজ দলের লোকজনকেও হামলা-মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করতে দ্বিধা করতেন না।
অভিযোগ রয়েছে, আব্দুর রহমানের ‘টাকা কালেকশনে’ তিনটি উপজেলাতেই ছিল তার বিশেষ কয়েক ব্যক্তি। এদের মধ্যে মধুখালীতে সাবেক পৌর মেয়র মোরশেদ লিমন ও আওয়ামী লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম বকু, বোয়ালমারীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিরধা পিকুল ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক শরীফ সেলিমুজ্জামান লিটু এবং আলফাডাঙ্গার সাবেক মেয়র সাইফার। এদের দিয়েই স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খাত থেকে টাকা আদায় করতেন।
শুধু নিজ নির্বাচনী এলাকাতেই নয়, ফরিদপুর সদর আসনেও ছিল আব্দুর রহমানের আধিপত্য। জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আব্দুর রহমানকে টাকা দিলেই পদ পাওয়া যেত। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের পদ বিক্রি করেই কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। শুধু আওয়ামী লীগই নয়, ছাত্রলীগের অনেককে টাকার বিনিময়ে জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের পদ দিয়েছেন। নগরকান্দা এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কাজী আব্দুস সোবহানকে জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি করেছেন কোটি টাকার বিনিময়ে- এমন কথা এলাকায় চাউর রয়েছে।
আব্দুর রহমানের স্ত্রী মির্জা নাহিদ ইসলাম বন্যা ও তার শ্যালক পিন্টুর বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এরা দুজন মিলে তিনটি উপজেলায় থানার দালালি, মনোনয়নবাণিজ্য ও চাকরি দেওয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী হওয়ার পর আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি উপজেলায় চাকরি দেওয়ার নাম করে হাজারো মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এক সময়ের দরিদ্র পরিবারের সন্তান আব্দুর রহমানের নামে বেনামে ঢাকার পূর্বাচল, ধানমন্ডি, উত্তরা, পরীবাগে বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। অবৈধ উপায়ে টাকা কামিয়ে আমেরিকা, কানাডাসহ পাঁচটি দেশে বিলাসবহুল বাড়ি করার কথা জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ঢাকার পরীবাগের বাড়িতে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধরা। এ সময় বাড়িটি ভাঙচুর করা হয়। এর পর থেকে দেখা মেলেনি এক সময়ের দোর্দ- প্রতাপশালী আব্দুর রহমানের।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানতে আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার অবস্থানের কথা কেউ জানাতে পারেনি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে কথা বলা সম্ভব হয়নি।