বিএনপির সঙ্গে বিচ্ছেদের খবরের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত ‘ক্রিমিনাল দল’ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ৯ বছর আগে হাইকোর্ট কর্তৃক নিবন্ধন বাতিল হলেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে আপিল বিভাগে। কোনো জোটে না থাকলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণও অসম্ভব। এদিকে মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের অপরাধমূলক কর্মকা-ের কারণে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারও ঝুলে আছে আইন সংশোধনের অপেক্ষায়। দলটিকে নিষিদ্ধের দাবি উঠলেও এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকারও। সব মিলে দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান ঝুলন্ত।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) ও আপিল করেন, যা এখানো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
যদিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই বক্তব্যকে জামায়াতের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য নয় বলে দাবি করেন দলটির নেতারা। তবে বিএনপি নেতাদের অনেকে বলছেন, জোটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দুই দলের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্দেহ সৃষ্টি করা হয়েছে।
এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হলেও দলটিকে বেআইনি ঘোষণা না করার পেছনে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গোপন সম্পর্ক কাজ করছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মুখে প্রায়ই শুনি, যেটা বুলি হয়ে গেছে। তারা প্রায়ই বলে, বিএনপি-জামায়াত, বিএনপি-জামায়াত। আমি বলছি, এখন সময় এসেছে আওয়ামী-জামায়াত, আওয়ামী-জামায়াত বলার। ওনারা (আওয়ামী লীগ) জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে, কিন্তু বেআইনি ঘোষণা করে না। তাহলে কি আমি বলব, ওনাদের পরকীয়া প্রেম চলছে!’
বিএনপি নেতার এই বক্তব্যকে ‘অশালীন’ বলেছে জামায়াতে ইসলামী। গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত যে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন, তা দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে। এটি কোনো রাজনীতিবিদের ভাষা হতে পারে না।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবন্ধ হয়ে অংশ নেওয়া দল দুটির পারস্পরিক বক্তব্য নিয়ে সরগরম দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে দলটির গোপন সখ্যের বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই দলটি নিষিদ্ধ করার জন্য বলে আসছি। রাষ্ট্রবিরোধী দলটি নিষিদ্ধ না করলে সরকারের সব অর্জন বিলীন হয়ে যাবে। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা-ের জন্য দলটিকে দ্রুত নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ দলটি পাকিস্তানের শাখা সংগঠন। ৭২ সংবিধানের মর্যাদা রক্ষায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত।’ দলটির বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জামায়াতের নেতারা দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন। সেক্ষেত্রে নেতাদের বিচার হলে দলের কেন হবে না?
এদিকে একাত্তরে ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয় বলে মত জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এই মত দিয়েছেন বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর বিচার ও দলটি নিষিদ্ধের জন্য বিভিন্ন দল, সংগঠন, ব্যক্তির পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীরাও দাবি করেছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের আগস্টে জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে তদন্ত শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। পরের বছর ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্তও করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান নেই।
জানা গেছে, ওই বছরই অপরাধী হিসেবে সংগঠনের শাস্তির বিধান রেখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রস্তাবিত ওই সংশোধনীতে ট্রাইব্যুনালস আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘ব্যক্তি’ শব্দটির পর ‘অথবা সংগঠন’ সন্নিবেশ করা হয়। আরেকটি ধারায় ‘দায়’ শব্দটির পরিবর্তে ‘অথবা সাংগঠনিক দায়’ এবং আরেকটি ধারায় ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি’ পরিবর্তে ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠন’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করার কথা বলা হয় প্রস্তাবিত সংশোধনীতে। এ ছাড়া সংগঠন হিসেবে দোষী প্রমাণিত হলে ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান রাখার উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় ৮ বছর আগে আইনটির প্রস্তাবিত সংশোধনী আর মন্ত্রিসভায় ওঠেনি, যে কারণে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারও সম্ভব হয়নি।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ আন্দোলন থেকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি ইতোমধ্যে ওঠে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাতে সাড়া মেলেনি।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন। সে সময় ৩৮টি দলের সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী জামায়াতে ইসলামীও নিবন্ধিত হয়, যা পরবর্তীকালে বাতিল হয়। আইনানুযায়ী কোনো দল নিবন্ধিত না হলে সংগঠন হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারে, কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।