নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম, সরকারের অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেশনের যাঁতাকলে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেকটুকু ঠুকে দেয়া হয়েছে।
বুধবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র আমরা সবাই জানি। কারণ এখানে আমরা যারা উপস্থিত আছি, সাংবাদিকবৃন্দসহ আমাদের সবারই বলতে গেলে নির্দিষ্ট টাকায় সংসার চালাতে হয়। তাই আমরা যতটা তিক্তভাবে বাজারের মূল্যবৃদ্ধি অনুভব করতে পারি, তা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে যারা সম্পদের পাহাড় জমিয়েছে, যাদের দুর্নীতির টাকা এখন সুইস ব্যাংক, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, কানাডার বেগমপাড়া, ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা লাতিন আমেরিকান দ্বীপরাষ্ট্রে পাচার হচ্ছে তারা কখনোই অনুভব করতে পারবেন না। পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সরকারের মদদপুষ্ট সিন্ডিকেটকারীদের ভূমিকার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। মূল্যবৃদ্ধির এই দুর্নীতিবাজ চক্রের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে সরকারের চালিকাশক্তিরাই।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার মূলত চালাচ্ছেই এক ধরনের স্বার্থান্বেষী অর্থপিপাসু বণিক সমাজ। সরিষায় ভূত থাকলে ভূত তাড়াবে কে? রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তখন যা হবার তাই হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশে। এবারের বাজেটের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। স্বার্থের সংঘাত দেখা দিলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বরাবর প্রাধান্য পাচ্ছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, গত মাসাধিককাল থেকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের নেতিবাচক প্রভাবে এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল ও ভোগ্যপণ্যসহ সকল পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় ভোক্তারা যখন দিশেহারা তখন হঠাৎ করে বিনা নোটিশে রাতের অন্ধকারে জ্বালানি তেলের দাম নজিরবিহীন বৃদ্ধি ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানির এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি এর আগে আর কখনো হয়নি। ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম একবারে ৪৫% থেকে ৫১% একসাথে বাড়িয়েছে সরকার। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে দেশের মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেকটুকু ঠুকে দেয়া হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সর্বক্ষেত্রে। গরীব সীমিত আয়ের মানুষেরা দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষেও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, এতে জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। গণপরিবহন থেকে কাঁচাবাজার- সর্বক্ষেত্রে কয়েকগুন মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে সবাই। প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে, তারা মিছিল করছে। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সারাদেশে আগুন জ্বলছে। জ্বলানির মূল্য যদি বাড়াতেই হতো সরকার তা সহনীয়ভাবে ধাপে ধাপে বাড়াতে পারত। হঠাৎ করে রাতের আঁধারে একবারে এত বেশি দাম বৃদ্ধিতে জ্বালানি ব্যবহার-সংশ্লিষ্ট সকলেই হতচকিত হয়ে পড়েছে। যাত্রী, ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই বিস্ময়ে হতবাক।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্যের অজুহাত দেখিয়ে দেশে জ্বালানির দাম বাড়ালেও, বাস্তবতা হলো বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম যখন ১৩০ ডলার থেকে ৯০ ডলারে নেমে এসেছে এবং আরো কমে আসছে, বাংলাদেশে তখনই জ্বালানি মূল্য এক লাফে এত বেশি বাড়ানো হয়েছে। মূলত এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসায় জ্বালানি তেলের দর বাড়ানোর টেকনিক নিয়েছে সরকার। এক লাফে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক, অমানবিক ও অবিবেচক। সরকারের বেপরোয়া দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অপরিণামদর্শিতার দায় পুরোপুরি সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ৩৪ টাকা কর আদায় করে সরকার। প্রকারান্তরে যার দায়ভার পড়ে ভোক্তা পর্যায়ে জনগণের ওপর। এই দুর্যোগকালে সাময়িক সময়ের জন্য জ্বালানি আমদানিতে কর আদায় মওকুফ করা হলে আকাশ ভেঙে পড়ত না। সরকারের রাজস্ব বিভাগ তো সরকারের অংশ। সরকার চাইলেই এনবিআর এই কর মওকুফ করতে পারে। কিন্তু সরকার তা করেনি, করবেও না। তাদের তো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর টাকা লাগবে। আর এনবিআরকেই জনগণের পকেট কেটে ওই টাকা যোগাড় করে দিতে হয়।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের মূল্য অনেক হ্রাস পায়, তখন বাংলাদেশে কেন তা কমানো হয়নি? গত কয়েক বছর ধরে বিপিসি বিশ্ববাজার থেকে কম দামে জ্বালানি কিনে এনে দেশে অনেক বেশি দামে বিক্রি করেছে। এভাবে বিপিসি প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা প্রফিট করেছে। ওই লাভের টাকা থেকে বর্তমানে তেল আমদানির অর্থ যোগান দিতে পারে সরকার। কিন্তু সরকার তা করবে না। জনগণের কাঁধে চাপানোই তাদের জন্য সহজ পথ।
ফখরুল আরো বলেন, সরকার ভোক্তাদের কাছে গ্যাস বিক্রির সময় গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (জিডিএফ) কথা বলে গত কয়েক বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা এ ফান্ডে জমা করেছে। কথা ছিল, এ অর্থ নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কারে ব্যয় করা হবে। কিন্তু সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এতদিন বঙ্গোপসাগর বা সারাদেশে গ্যাস উত্তোলনে কোনো অর্থ ব্যয় না করে দলীয় ব্যবসায়ীদের আর্থিকভাবে লাভবান করার জন্য বরং বেশি দামে এলএনজি আমদানিতে অর্থ ব্যয় করেছে। এখন এই জিডিএফ ফান্ড থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে এলএনজি কিংবা তেল আমদানি করছে বলে জানা গেছে।