সোমবার, ১১:৫০ পূর্বাহ্ন, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

জনশক্তি ব্যবসার প্রতারণায় জিম্মি বিদেশগামীরা

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
  • ৫৫ বার পঠিত

বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নামে সাম্প্রতিক অভিনব কায়দায় প্রতারণা বাড়ছে। আর এই প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ছে খোদ জনশক্তি পাঠানোর সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) কতিপয় সদস্য। শুধু বায়রার সদস্যরা নন, তাদের (রিক্রুটিং এবং ট্র্যাভেল এজেন্সি) প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙ্গিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার এজেন্সি মনোনীত প্রতিনিধি ও একশ্রেণীর দালাল পাসপোর্ট সংগ্রহ করছে। একই সাথে তারা বিদেশ যাওয়ার সিকিউরিটির টাকা জমা রাখার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা।

বিদেশগামী ও ভুক্তভোগী স্বজনদের অভিযোগ, দালালরা পাসপোর্ট বই কালেকশন আর টাকা আদায় করে নিজ নিজ রিক্রুটিং এজেন্সিতে জমা দেয়ার পরও মাসের পর মাস বিদেশগামীদের গন্তব্য দেশে না পাঠিয়ে আজ-কাল বলে বলে শুধু ঘুরানো হচ্ছে। মাস পেরিয়ে বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও বিদেশ যেতে না পারা লোকগুলো একপর্যায়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। অনেকে আবার এলাকায় সালিস বৈঠকের মাধ্যমে জমা টাকা তুলছেন। কেউ টাকা ফেরত নিতে পারছে আবার কেউ পারছে না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিদেশগামীরা তাদের জমা দেয়া পাসপোর্ট ফেরত নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া ও রোমানিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলোতে লোক পাঠানোর কথা বলে গ্রাম ও শহরপর্যায়ের স্থানীয় দালালরা বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির নামে পাসপোর্ট বই ও সাথে সিকিউরিটির টাকা বাবদ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ পর্যন্ত টাকাও আদায় করছে। পরে বিদেশগামী ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে খোঁজ নিতে গেলে তাদেরকে অনলাইনের একটি রেজিস্ট্রেশন ডকুমেন্ট ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারাও ওই ডকুমেন্ট দেখে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এমন ভেবে কিছুটা স্বস্তিতে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। এ সময় রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস থেকে তাদের কাউকে ৪ মাস পর আবার কাউকে ৫-৬ মাস পর ভিসা আসা সাপেক্ষে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। একই প্রক্রিয়ায় কিছু লোককে বিদেশ পাঠালেও অধিকাংশ লোকই যেতে পারছে না।

সাম্প্রতিক ফেসবুকে রোমানিয়া ও মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর অভিনব বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে নামধারী এজেন্সির লোকজন। তারা তাদের ফেসবুক পেইজে নিজস্ব কিংবা ফেক আইডি খুলে চটকদার বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর ও ব্যক্তির নামও জুড়ে দিচ্ছে। এসব বিজ্ঞপ্তি দেখে অনেকে প্রলোভনে পড়েও সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

গতকাল রোববার সন্ধ্যার পর ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপনের দেখা মেলে। ড্রিমফুল ট্র্যাভেল এজেন্সি নামক প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে দেয়া ওই বিজ্ঞাপনের ভাষায় উল্লেখ রয়েছে, রোমানিয়া ওয়ার্ক পারমিট ভিসা। এজেন্টের জন্য বিশেষ ছাড়। এতে মোবাইল নাম্বার দেয়া রয়েছে রবিন ০১৯৭৬৮২২০১০৯। ঠিকানা ৩৯, দিলকুশা সি/ এ মতিঝিল।

প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে ওই বিজ্ঞাপনে দেয়া মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করলে রবিন ফেসবুকে রোমানিয়া ও মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর বিজ্ঞাপন দেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের গভর্মেন্টের এপ্রুভাল আছে। লাইসেন্স নম্বর হচ্ছে ১৪০০৬। সিভিল অ্যাভিয়েশন থেকে অনুমোদনও নেয়া আছে। বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সির (আরএল) লাইসেন্স থাকতে হয়। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে রবিন বলেন, ‘আমাদের লাইসেন্সের জন্য আবেদন পেনডিং আছে। রোমানিয়া যেতে কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোট টাকা লাগবে ৭ লাখ ২০ হাজার। এর মধ্যে পাসপোর্ট ও ডকুমেন্টের সাথে জমা দিতে হবে প্রথমে এক লাখ টাকা। ভিসা আসার পর আরো ২ লাখ টাকা দিতে হবে। বাকি টাকা ফ্লাইটের আগে দিতে হবে। একইভাবে মালয়েশিয়ায় যেতে চাইলে সেখানেও মেডিক্যাল ফিট হওয়া সাপেক্ষে পাসপোর্টের সাথে প্রথমে এক লাখ টাকা দিতে হবে। কলিং ভিসা আসলে বাকি টাকা দিতে হবে। এরপর রবিন জানতে চান আপনি কবে আসবেন আমাদের অফিসে। আমি আপনার নাম্বার সেভ করে রাখছি। আমি পরে আবার আপনাকে ফোন দেবো।’ শুধু রবিন নয়, রোমানিয়ায় লোক পাঠানোর নামে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ফেসবুকে এভাবেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মানুষকে প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।

চাঁদপুরের বাসিন্দা নজরুল (ছদ্মনাম)। তিনি রোমানিয়া যাওয়ার জন্য পুরানা পল্টনের আকরাম টাওয়ারের একটি অফিসে ৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে পাসপোর্ট ও নগদ ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন। বিদেশ যাওয়ার কোনো মেসেজ না পাওয়ায় তিনি এখন পুরান ঢাকায় তার এক আত্মীয়ের কাছে অবস্থান করছেন। বর্তমানে বসে না থেকে তিনি বিকাশের দোকান খুলেছেন। তিনি বলেন, রোমানিয়ায় যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি। কিন্তু কোনো খবর পাচ্ছি না। দালালের মাধ্যমে আকরাম টাওয়ারের একটি অফিসে পাসপোর্ট ও নগদ ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়েছি। তারা আমাকে বলেছেন, ভিসা আসতে ৪ মাস সময় লাগবে। সেই সময়ও অতিবাহিত হতে চলেছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে দালালরা পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিভিন্ন এজেন্সিতে জমা দিচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে কেউ কেউ আবার বিদেশে গিয়েছেনও। তাদের দেখে অন্যরা দালালদের কাছে টাকা পাসপোর্ট জমা দিচ্ছেন। তার মতে, কিছু প্রতিষ্ঠান লোক পাঠাতে না পারলে টাকা ফেরত দেয়। এ নিয়ে সালিস বৈঠক হয়। অনেকে আবার বৈঠকের পরও টাকা ফেরত দিতে চায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বায়রার হাজারো সদস্য এখন বিদেশ পাঠানোর নামে বিদেশগামীদের পাসপোর্ট তাদের হেফাজতে রেখেছেন। একই সাথে জামানতও নিয়ে রাখছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন এক লাখ লোকের মেডিক্যাল করালে টাকা নিচ্ছে তার দশগুণ মানুষের কাছ থেকে। পরে অনেকে ভিসা সংগ্রহ করতে না পেরে এক-দুই বছর ঘুরিয়ে টাকা আস্তে আস্তে ফেরত দিতে রাজি হন। এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।

গতকাল রাতে এশিয়া কন্টিনেন্টাল গ্রুপ বিডির কর্ণধার লোকমান শাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, ইদানীং ফেসবুকে পেইজ খুলে লোক নিয়োগের দেদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ। তিনি বলেন, ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিস থেকে কিভাবে লোক পাঠানোর বিজ্ঞপ্তি দেয়? এসব আমাদের সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবশ্যই মনিটরিং করা উচিত। লোক পাঠাবে রিক্রুটিং এজেন্সি। এমনও তো হতে পারে ট্র্যাভেল এজেন্সির নাম ব্যবহার করে প্রতারকরা এসব করছে- জানতে চাইলে লোকমান শাহ বলেন, প্রশাসন তদন্ত করলেই বের হবে এসবের সাথে কারা জড়িত। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এভাবে লোক নিয়োগের কারণে বর্তমানে ইউরোপের শ্রমবাজার তাদের হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হতে যাচ্ছে, যা মোটেও কাম্য নয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com