আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বহুল প্রতীক্ষিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৮ ডিসেম্বর। ৩০তম এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মধ্যে বেড়ে গেছে নানামুখী তৎপরতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র মধুর ক্যান্টিন এখন বেশ সরগরম। ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়, টিএসসিসহ রাজনৈতিক আড্ডাস্থল তো বটেই, নেতাদের ড্রয়িংরুমেও গড়িয়েছে কমিটি গঠন নিয়ে নানামুখী আলোচনা, গ্রুপিং-লবিং। চেষ্টা-তদবিরের কমতি নেই। এ ছাড়া ব্যানার-পোস্টার, মিছিল-সমাবেশে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন অনেকে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, ছাত্রলীগের সম্মেলন নিয়ে নানা কথা হচ্ছিল। অনেকে বলছিলেন এই সম্মেলন হবে না। কিন্তু সব সমালোচনা পেছনে ফেলে রেখে সংগঠনটির সরাসরি অভিভাবক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সম্মেলনের তারিখ দিয়েছেন। এই সংগঠন নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলে; ভবিষ্যতেও চলবে। এটাই ছাত্রলীগের নান্দনিকতা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাংগঠনিক সক্ষমতা রয়েছে; ত্যাগী, পরিচ্ছন্ন ইমেজ ইত্যাদি বিষয় হবে আগামীর নেতৃত্ব নির্বাচনের ভিত্তি। এ ছাড়া যারা শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয়মুখ হিসেবে বিবেচিত, বিভিন্ন মানবিক কর্মকা-ের মাধ্যমে আলোচনায় এসেছেন, এমন ছাত্রনেতারা নেতৃত্বপ্রাপ্তির বিষয়ে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। আরও একটি বিষয় নেতৃত্ব নির্বাচনে বেশ গুরুত্ব পাবে- আগামী জাতীয় নির্বাচন। এবার যারা নেতৃত্বে আসবেন, আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে তারাই থাকবেন নেতৃত্বে। কাজেই নেতা নির্বাচনকালে জাতীয় নির্বাচনের ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা আছে, এমন নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করাও হবে নতুন নেতৃত্বের অন্যতম দায়িত্ব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে তাদের কর্মকা-ও হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক। তাই ছাত্রলীগের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের তেমন কোনো তৎপরতা দৃষ্টিগোচর হয় না। শুধু নির্দিষ্ট কিছু দিবসে কর্মসূচি পালনের জন্য নেতারা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। লিয়াকত-বাবুর পর ২০০৬ সাল থেকে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হয়ে আসছে। প্রতিবারের সম্মেলনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের অনেক যোগ্য ও ত্যাগী নেতা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শীর্ষপদে আসীন হতে পারেন না শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা নন বলে।
আসন্ন সম্মেলনে ঢাবির বাইরের নেতাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের আহমেদ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এবং বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামিউস সানী, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের নেতা আল-আমিন শেখসহ অনেকেই আছেন আলোচনায়।
সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন যথাক্রমে লিয়াকত শিকদার ও নজরুল ইসলাম বাবু। লিয়াকত শিকদার ঢাকা কলেজ এবং নজরুল ইসলাম বাবু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ দুই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরও আগে একেএম এনামুল হক শামীম কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
রাজনীতির বর্ণাঢ্য ইতিহাসে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটির ৭৪ বছরের ইতিহাসে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কখনো নারী নেতৃত্ব দেখা যায়নি। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মারুফা আক্তার পপি। তিনি সে সময় ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলেন। তখন তাকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করার দাবিও ওঠে। কিন্তু বিরোধী দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে ব্যাপক রাজনৈতিক চাপ সামাল দিতে হবে ভেবে শেষ পর্যন্ত তাকে আর কেন্দ্রের সভাপতি করা হয়নি। গত দুবারও অর্থাৎ ২৮তম ও ২৯তম কাউন্সিলেও একাধিক নারী নেতৃত্ব আলোচনার শীর্ষে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি আলোচনাতেই থেকে যায়, কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কা-ারি হিসেবে শেখ হাসিনা অনেক বছর ধরেই সফলভাবে দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। অথচ এ দলেরই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কেন্দ্রে কখনো নারী নেতৃত্ব আসেনি! ছাত্রলীগের নারী নেতৃত্বের প্রত্যাশা তাই দিন দিন বাড়ছে। এবার সেই প্রত্যাশা আলোর মুখ দেখতে পারে। আসন্ন ৩০তম সম্মেলনে নারীদের মধ্যে আলোচনায় আছেন সুফিয়া কামাল হলের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি, ডাকসুর সাবেক সদস্য, ঢাবির সিনেট সদস্য ও ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি তিলোত্তমা সিকদার; কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি, ডাকসুর সাবেক সদস্য ও ঢাবি কুয়েত মৈত্রী হলের সাবেক সভাপতি ফরিদা পারভীন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক, ঢাবির ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রনক জাহান রাইন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রবীণ এক নেতা বলেন, ‘আমাদের নেত্রী (শেখ হাসিনা) সব সময় নারী নেতৃত্ব তথা নারীর ক্ষমতায়নে বিশ^াসী। সুতরাং তিনি যথাসময়ে যথার্থ সিদ্ধান্তই নেবেন। সব বিষয়েই তিনি অবগত আছেন।
আলোচনায় আছেন যারা
ছাত্রলীগের বিগত কমিটিগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভাগভিত্তিক রাজনৈতিক মেরুকরণের জন্য এক এক সময় এক এক বিভাগ থেকে নেতৃত্ব নিয়ে আসা হয়। বিগত সময়ে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চল থেকে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ, খুলনা, ময়মনসিংহ এবং সিলেট বিভাগ। বলা বাহুল্য, তারা প্রত্যেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
ছাত্রলীগের বিগত কয়েকটি কমিটি শীর্ষ নেতৃত্বের নির্বাচনের প্রক্রিয়া, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অঞ্চলভিত্তিক যেসব পদপ্রত্যাশী এগিয়ে আছেন তারা হলেন-
বরিশাল অঞ্চল থেকে সহসভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসাইন, সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ ইনান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপবিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক সবুর খান কলিন্স। বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে সহসভাপতি রাকিব হোসেন, কামাল খান এবং কর্মসংস্থানবিষয়ক সম্পাদক রনি মাহমুদ। চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে সহসভাপতি মাজহারুল ইসলাম শামীম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাহসান আহমেদ রাসেল, সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের, উপসমাজসেবা সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, উপসাহিত্য সম্পাদক জয়জিৎ দত্ত। উত্তরবঙ্গ থেকে প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক হায়দার মোহাম্মদ জিতু, ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি খায়রুল হাসান আকন্দ, মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক মেহেদি হাসান তাপস, সহসম্পাদক রাকিব সিরাজী। খুলনা অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম বাঁধন।
বয়স নিয়ে বিতর্কিত নেতারা বাদ পড়তে পারেন
বয়সের কারণে বিতর্কিত অনেক নেতা এবার বাদ পড়তে পারেন। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাথমিক সদস্য হতে হলে তার ছাত্রত্ব থাকতে হবে এবং বয়স অনূর্ধ্ব ২৭ বছর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২ বছর পরপর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে অধিকাংশ সময়ই এই নিয়মেরও ব্যত্যয় ঘটেছে। ফলে কোনো কমিটি আড়াই বছর; আবার কোনো কমিটি ৩ বছরের বেশি সময় অতিবাহিত করেছে। নিয়মের এই ব্যত্যয়ের ফলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বয়সের ব্যাপারেও ছাড় দিতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কোনো কমিটির সময় এক বছর, আবার কোনো কমিটির সময় ২ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
গত তিন সম্মেলনে ছাত্রলীগের বয়স গঠনতন্ত্রের বাইরে দু-এক বছর করে বাড়ানো হয়েছে। ২০১১ সালে সংগঠনটির ২৭তম সম্মেলনে নেতৃত্বে আসেন সভাপতি হিসেবে বদিউজ্জামান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সিদ্দিকী নাজমুল আলম। এর আগে ২০০৬ থেকে ২০১১ সালে সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন। ওই সময় বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। সেই হিসেবে ৫ বছর পর অনুষ্ঠিত ২০১১ সালের সম্মেলনে বয়স ধরা হয় ২৯ বছর। এর ৪ বছর পর ২৮তম সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসেন। ওই সম্মেলনে বয়স নির্ধারণ করা হয় ২৯ বছর। এরপর সর্বশেষ সম্মেলনে নেতৃত্বে আসেন রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং গোলাম রাব্বানী। সম্মেলনে তাদের বয়সসীমা ধরা হয় ২৮ বছর। যদিও পরে সেটি আরও ১ বছর বাড়িয়ে ২৯ বছর করা হয়। তবে গত তিন কমিটিতে ২৯ বছর হলেও করোনা মহামারী এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এবার আরও এক বছর বাড়তে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের বড় অংশের বয়স গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ। যদিও পুরনো প্রচলন অনুযায়ী দু-এক বছর বাড়বে- এই আশায় অনেকেই প্রার্থী হয়েছেন বলে জানা যায়।
এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নেতৃত্বে আসার আলোচনায় আছেন রফিকুল ইসলাম সবুজ, শহীদুল হাসান শিশির, হাসিবুল হাসান শান্ত, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, তানভীর সিকদার ও রিয়াজুল ইসলাম।
ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন সুজন সভাপতি প্রার্থী এবং উপকর্মসূচি পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক বুলবুল আহমেদ এই ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা এখনো দৃশ্যমান নয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণে ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির আহমেদ এই ইউনিটে সভাপতি পদে আসতে পারেন এমন আলোচনা রয়েছে।