একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত সুশৃঙ্খল হবে, সেই দেশের শিক্ষার মান তত ভালো হবে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে শুরু থেকে শেষ অবধি গলদে ভরা। সেই সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে যাওয়ার পদ্ধতিতেও রয়েছে সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যার্জনের স্থান বলা হয়। যেখানে গবেষণালব্ধ পড়াশোনা থাকার কথা, সেখানেও মুখস্থনির্ভর পড়াশোনা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জ্ঞানচর্চার জায়গায় সিলেবাস ও শিটভিত্তিক পড়াশোনা কতটুকু যুগোপযোগী, তা প্রশ্নই থেকে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে বসার জায়গা পাওয়া যায় না। সেখানে শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো চাকরির বই পড়ছেন। কারণ, একাডেমিক পড়াশোনা করে চাকরি পাচ্ছে না বললেই চলে। তাই বলা যায়, হয় একাডেমিক পড়াশোনার পদ্ধতি ভুল, কিংবা চাকরির পরীক্ষার পদ্ধতি ভুল। দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে তাঁরা এখন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রতিযোগিতা করছেন।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, একাডেমিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, চাকরির পরীক্ষায় সেভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় না৷ একজন শিক্ষার্থী সহজে জিপিএ-৫ পাচ্ছেন কিংবা সিজিপিএ ওঠাতে পারছেন। কিন্তু একজন প্রার্থী চাইলেই সহজে চাকরি পাচ্ছেন না। কারণ, একাডেমি পড়ালেখার সঙ্গে চাকরির পড়াশোনার সামঞ্জস্য নেই বললেই চলে।
ঢাবি অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজে লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। যেখান শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না৷ কয়েক দিন আগে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ফল পাওয়ার পর অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, শিক্ষকেরা খাতার পেজের সংখ্যা এবং হাতের লেখা দেখে নম্বর দিয়েছেন, যা খুবই দুঃখজনক। যদি এভাবে শিক্ষার্থীদের যাচাই-বাছাই করা হয়, তাহলে দিন শেষে তাঁদের কী হবে, তা প্রশ্ন থেকেই যায়!
উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিবছর আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ বিদেশে যাচ্ছে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৫৭টি দেশে প্রায় ৪৯ হাজার শিক্ষার্থী যান। ২০২২ সালে ১১ হাজার শিক্ষার্থী শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই পাড়ি জমিয়েছেন। ইউনেসকোর তথ্য বলছে, ৭০ থেকে ৯০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি জমান। তাঁদের খুব কমসংখ্যকই দেশে ফিরে আসে।
দেশে চাকরির অনিশ্চয়তা, শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্যের রাজনীতি, বিদ্যাপীঠে অনুকূল পরিবেশ না থাকা, লেখাপড়ার বৈশ্বিক মানের ঘাটতি। মোটাদাগে এ চার কারণেই বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহী শিক্ষার্থীরা। দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অনার্স শেষ করে আরও দুই থেকে তিন বছর দরকার হয় একটা কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়ার জন্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেও মিলছে না চাকরি। অথচ দেশে হাজার হাজার চীনা, কোরীয়, ভারতীয়রা চাকরি করে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চিন্তা করেন, আমি একাডেমিক পড়াশোনা যতই করি না কেন দিন শেষে আমাকে অঙ্ক, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি পড়তেই হবে। তাই প্রথম বর্ষে থেকে চাকরির পড়াশোনা শুরু করে দেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সমাজ মনে করে, সরকারি চাকরিজীবী মানে বিশাল বড় বিষয়। আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে সফল উদ্যোক্তার তুলনায় সরকারি অফিস সহকারীর মূল্য অনেক বেশি। এ থেকে বুঝতে যায়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মমুখী শিক্ষা চালু করতে হবে। কারণ, কর্মমুখী-কারিগরি শিক্ষা বর্তমান যুগের জন্য যুগোপযোগী। দেশে উচ্চশিক্ষার এত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ভর্তি না করিয়ে শিক্ষার গুণ-মানের দিকে নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে চাকরির পড়াশোনার আলোকে একাডেমিক সিলেবাস সাজাতে হবে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশোনায় গুরুত্ব দিতে পারেন। তাই একাডেমিক শিক্ষা ও চাকরির পরীক্ষায় সামঞ্জস্য আনতে হবে।
সাকিবুল হাছান
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ