দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনকে কাছে পেতে চায় বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গত শুক্রবার বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ ১০ সদস্যের একটি দল বরিশালের চরমোনাই দরবার শরিফের বার্ষিক মাহফিলে হাজির হয়। সেখানে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দুই দলের নেতাদের আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, সেখানে যাওয়ার জন্য তাঁদের কোনো ‘দলীয় অ্যাজেন্ডা’ ছিল না। মাহফিলে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই আমন্ত্রণ পেয়েই তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে চরমোনাই পীরের সঙ্গে তাঁদের কুশল বিনিময় হয়েছে। দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে প্রসঙ্গক্রমে কথাবার্তা হয়েছে। এর বাইরে কিছু নয়।
অবশ্য বিএনপির দলীয় একটি সূত্র বলছে, বিএনপি চাইছে, তাদের চলমান নির্দলীয় সরকারসহ ১০ দাবির পক্ষে অন্য সমমনা দলগুলোর মতোই চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন শরিক হোক। দলটির লক্ষ্য, ১০ দফা দাবির সপক্ষে যত বেশি রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে, তত বেশি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই বিএনপির প্রতিনিধিদলটি চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের মনোভাব বোঝার জন্য মাহফিলে গিয়েছিল। এ সময় বিএনপি নেতারা সেখানে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। দরবারের মেহমানখানায় এই ভোজের ফাঁকে চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি রেজাউল করীমসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়কালে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
বিএনপির প্রতিনিধিদলে উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, কেন্দ্রীয় মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দীন স্বপন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হোসেন খান, বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবুল কালাম।
বৈঠকের বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চরমোনাই পীর সাহেবের দাওয়াত পেয়ে মাহফিলে গিয়েছিলাম। পরে সেখানে রাজনৈতিক অনেক বিষয় নিয়ে খোলোমেলা ও প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে। যেহেতু আমরা রাজনীতি করি, সেটা তো হবেই। তবে সেখানে কোনো আলাদা অ্যাজেন্ডা নিয়ে আমরা যাইনি। এর বেশি কিছু না।’
বৈঠক সূত্র জানায়, নির্দলীয় সরকার নিয়ে আলোচনা তুললে চরমোনাই পীর ও তাঁর দলের নেতারা বলেন, তাঁরা তত্ত্বাধায়ক সরকার নয়; বরং সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। তাঁরা এটাও বলেন, বিএনপির কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলেছে, ইসলামী আন্দোলনও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ বিষয় নিয়ে আলোচনা ও জনমত গঠনে কাজ করা যেতে পারে বলেও মত দেন দলটির নেতারা।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এককভাবে ১৬০টি আসনে অংশ নেয় ইসলামী আন্দোলন। ওই নির্বাচনে দলটি ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ভোট, অর্থাৎ ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৪ ভোট পেয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েও অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না—এমন অভিযোগ করে অংশ নেয়নি দলটি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনেই প্রার্থী দিয়ে আলোচনায় আসে ধর্মভিত্তিক দলটি। ওই নির্বাচনে একটি আসনে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়। ভোট গ্রহণের দিন নানা অনিয়মের অভিযোগে একপর্যায়ে ফলাফল বর্জনের ঘোষণা দিলেও প্রায় ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ ভোট পড়ে দলটির বাক্সে। অর্থাৎ প্রায় ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৩ ভোট যায় তাদের ‘হাতপাখা’ প্রতীকে। এরপর স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচনে এই দলের প্রার্থীরা ভালো ভোট পেয়েছেন। এতে ভোটের রাজনীতিতে দলটির গুরুত্ব বেড়েছে।
দেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ার বিষয়টিও আঁচ করতে পারছেন ইসলামী আন্দোলনের নেতারা। এ জন্য তাঁরা আপাতত স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। সে কারণে গত শুক্রবার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে সামান্য আলোচনা হলেও চরমোনাই পীরের কাছ থেকে ১০ দফা দাবির প্রতি সমর্থনের কোনো সায় পাননি বিএনপি নেতারা।
সভায় উপস্থিত দুই দলের চার নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, বিএনপি নেতারা ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষনেতাদের চলমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের দলটির সমর্থন চান। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপরেখা বিষয় নিয়েও আলাপ করেন। জবাবে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিটি কোনো মৌলিক দাবি হতে পারে না। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সেসব নির্বাচনকে দুই দল একমত হয়ে মেনে নিতে পারেনি। যে দল জিতেছে তারা স্বাগত জানিয়েছে, আর যে দল জিততে পারেনি তারা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছে। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্বচ্চ নির্বাচনের প্রক্রিয়া নয়। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার।
বিএনপি নেতারা তারেক রহমানের কল্যাণ রাষ্ট্রের ব্যাপারে কথা তুললে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা সে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তাঁরা বলেন, বিএনপি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেনি। এ সময় দলটির নেতারা জাতীয় সংসদে প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশনাল (পিআর) বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন। অর্থাৎ, প্রতিটি দলের ভোটের অনুপাতে আসনগুলো বরাদ্দ করার পদ্ধতির ওপর জোর দেয় ইসলামী আন্দোলন।
ইসলামী আন্দোলনের এসব প্রস্তাবনার বিষয় নিয়ে বিএনপি নেতারা দলের নীতিনির্ধাণী পর্যায়ে আলোচনা করবেন বলে আশ্বাস দেন।
বৈঠকে উপস্থিত ইসলামী আন্দোলনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আশরাফ আলী আকন আজ সোমবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক দাবিটি মৌলিক দাবি হতে পারে না। এখন আন্দোলন হওয়া উচিত দেশের মানুষকে নিত্যপণ্যসহ নানাভাবে দিশাহারা অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য। তাঁরা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, রাষ্ট্রকে একটি প্রকৃত কল্যাণকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চান। এ জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। এ জন্য তাঁরা পিআর পদ্ধতি চালু ও জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছেন।
আশরাফ আলী আকন বলেন, ‘অতীতে তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এখনো পারবে না। এখন আওয়ামী লীগ চায় একদলীয়; বিএনপি চায় নির্দলীয় সরকার। আমরা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য জাতীয় সরকার চাই। বিএনপি নেতাদের আমরা এটাও বলেছি, তাঁরা অতীতে কথা দিয়ে রাখেননি। এ নিয়ে যে দূরত্ব হয়েছে, সেটি সময় নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।’
বৈঠকের প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির কেন্দ্রীয় মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দীন স্বপন আজ সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামী আন্দোলন ধর্মভিত্তিক ও নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল। তাঁরা মাহফিলে সব দলকেই আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণ পেয়েই তাঁরা ১০ জনের প্রতিনিধি দল গঠন করে মাহফিলে গিয়েছিলেন। সেখানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বেশ কিছু খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।
১০ দফা দাবিতে বিএনপির চলমান আন্দোলনে শরিক হতে ইসলামী আন্দোলনকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানান জহির উদ্দিন। তিনি বলেন, দাবির বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন— এসব দাবি নিয়ে তাঁরা ভিন্ন অবস্থান থেকে আন্দোলন করছেন। যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে দুই দলের আরও কাছাকাছি আসা সম্ভব হবে। তবে দেশ রক্ষা, এই সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উভয় দলই একমত হয়েছেন বলে জানান এই বিএনপি নেতা।
সুত্রঃ প্রথম আলো