গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেডের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অনুসন্ধান নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধান করে কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গত ৩১ জুলাই সংস্থার উপপরিচালক গুলশান আনোয়ারকে প্রধান করে এরই মধ্যে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দলের অপর সদস্যরা দুদকের সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তার ও মোহাম্মদ নুর আলম সিদ্দিকী।
অনুসন্ধান দল অভিযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে গতকাল সোমবার গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও এমডিকে চিঠি দিয়েছে। এর আগে গত ২৮ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন জানান, গ্রামীণ টেলিকমের দুই হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছেন তারা। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগিরই অনুসন্ধান দল গঠন করা হবে।
দুদকের চিঠিতে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক/কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অর্থ লোপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের পাওনা ৩৬৪ কোটি ১৭ লাখ ৯ হাজার ১৪৬ টাকা পরিশোধকালে অবৈধভাবে অ্যাডভোকেট ফি ও অন্যান্য ফির নামে ৬ শতাংশ অর্থ কর্তন, কল্যাণ তহবিলে বরাদ্দকৃত সুদসহ ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৩ টাকা বিতরণ না করে আত্মসাৎসহ গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির দুই হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। এ কারণে অনুসন্ধান দলের চাওয়া রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি আগামী ৭ আগস্টের মধ্যে দুদকে জমা দিতে প্রতিষ্ঠানটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুদক যেসব রেকর্ডপত্র চেয়েছে তার মধ্যে ১৯৯৭-২০২২ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদ থেকে দুই হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা নোবেল পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর সংক্রান্ত তথ্য ছক আকারে দিতে হবে। যার মধ্যে থাকবে অর্থ স্থানান্তরকৃত প্রতিষ্ঠানের নাম, বছর, তারিখ, ব্যাংকের নাম, হিসাব নম্বর, টাকার পরিমাণ। একই সঙ্গে কোম্পানি থেকে ওই অর্থ কোথায়, কীভাবে, কোন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কোন প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তির হিসাবে স্থানান্তর হয়েছে এবং পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে তাদের সর্ম্পক কী, এ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপিও জমা দিতে হবে। একই ভাবে ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের ৩৬৪ কোটি ১৭ লাখ ৯ হাজার ১৪৬ টাকার পাঁচ শতাংশ অর্থ প্রদান সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের ফটোকপিও লাগবে। এসব অর্থ কাকে কীভাবে, কোন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে তার তথ্য দিতে হবে ছকে। এ ছাড়া ১৯৯৭-২০২২ সাল পর্যন্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বাবদ শ্রমিক কর্মচারীদের পাওনা ৩৬৪ কোটি ১৭ লাখ ৯ হাজার ১৪৬ টাকা পরিশোধকালে ফি এবং অন্যান্য ফির নামে ৬ শতাংশ হারে টাকা কর্তন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের ফটোকপিও চাওয়া হয়েছে। এসব অর্থ কাকে কীভাবে, কোন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে তার তথ্য থাকতে হবে ছকে। প্রয়োজন সাপেক্ষে অন্যান্য রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি চাওয়া হবে।
চিঠিতে আরও যেসব রেকর্ডপত্র চাওয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে- ১৯৯৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের কল্যাণ তহবিলে বরাদ্দকৃত সুদসহ ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৩ টাকা বিতরণের রেকর্ডপত্রের কপি। এসব অর্থ কোম্পানির কল্যাণ তহবিলে স্থানান্তর করা না হলে ওই টাকা কোথায়, কীভাবে, কোন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে খরচ করা হয়েছে তার রেকর্ডপত্র দেখাতে হবে। এ ছাড়া ১৯৯৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের বিস্তারিত তথ্য, কোম্পানি পরিচালনার আইন ও বিধিসমূহ, পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্যের কোম্পানি থেকে ঋণ পাওয়ার বৈধ অধিকার রয়েছে কিনা, এখন পর্যন্ত পর্ষদের কোন সদস্য কত টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং ঋণের অর্থ কীভাবে উত্তোলন করেছেন, সেসব তথ্যাদিও ছকে থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি চাওয়া হয়েছে। একইভাবে কোম্পানিতে গ্রামীণ টেলিকমের কত শতাংশ শেয়ার রয়েছে এবং এ শেয়ারের বিপরীতে ১৯৯৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কত টাকা লভাংশ পেয়েছে, ওই লভাংশের টাকা কোন কোন খাতে কীভাবে ব্যয় করেছে, তার বছরভিত্তিক তথ্য ছক আকারে চাওয়া হয়।
এ বিষয়ে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দুদকে পাঠান। ওই অভিযোগ সংক্রান্ত প্রতিবেদন কমিশন পর্যালোচনা করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনুসন্ধানকালে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা অবশ্যই গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবেন এবং বিধিবিধান অনুসারে ব্যবস্থা নেবেন।
গ্রামীণ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়ার পরে আপনারাই জানতে পারবেন এর সঙ্গে কে কে সম্পৃক্ত। তিনি অনুসন্ধানের স্বার্থে যাদের প্রয়োজন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।