বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নির্ধারিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) আগামী সোমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি।
সব কিছু ঠিক থাকলে এটিই হবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ভারতীয় কোনো সিনিয়র কর্মকর্তার প্রথম ঢাকা সফর।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব যে বাংলাদেশে আসছেন এতেই দু’দেশের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের এই সফরে কোন বিষয়টিকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে পারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই মুহুর্তে এটা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে সাধারণভাবে সব ইস্যু নিয়েই আলোচনা হবে। ভারতের সঙ্গে তো আমাদের অনেক মেকানিজম আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের ট্রেড আছে, কানেকটিভিটি আছে, পানি আছে, বর্ডার আছে এগুলো অবশ্যই থাকবে। সুনির্দিষ্টভাবে এজেন্ডায় কী থাকবে সেটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে। সাম্প্রতিক ইস্যুও এর মধ্যে থাকবে। সংশ্লিষ্ট উইং এখনো এগুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। উনি আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।’
গত বুধবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, আমরা তাদের সঙ্গে (ভারতের সঙ্গে) সুসম্পর্ক চাই। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই এটা চাওয়া দরকার এবং এজন্য কাজ করা উচিত।’
পূর্বনির্ধারিত ১০ ডিসেম্বর এফওসি’র জন্য নির্ধারিত থাকলেও এটি এক দিন আগে ৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। এই বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি নিজ নিজ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরে দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো পর্যালোচনা, রাজনৈতিক বোঝাপড়া, ভারতীয় গণমাধ্যমের বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার, ভারতে বসে শেখ হাসিনার বক্তব্য, ভিসার জট খোলা, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, ভারত থেকে নিত্যপণ্য আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে রফতানির নানা বাধা সরানোসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হতে পারে। গত বছরের নভেম্বরে দিল্লিতে সর্বশেষ পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে।
এই বৈঠকে বরফ গলবে কিনা জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল অব. এম শহীদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব যে আসছেন এতেই দু’দেশের মধ্যে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদিও এটা রুটিন। তারপরও ভারত সরকার বাণিজ্য চালিয়ে যেতে যে পলিসি নিয়েছে, সেটাকেও আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। ইস্যু অনেক আছে। ভারতীয় হাইকমিশনার দু’দিন আগে বলেছেন, একটা ইস্যুতেই যেন সম্পর্ক না আটকে থাকে। আমি আশা করবো, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে যা যা আমাদের মধ্যে ছিল, সেটার চেষ্টা করবেন দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য কিন্তু অনেক। মেডিকেল আর ট্যুরিজম বাদে যদি আমরা দেখি, যেমন আমরা লাভবান, তেমনি তারাও লাভবান। ভারতের যেমন আমাদের দরকার, তেমনি আমাদেরও ভারতকে দরকার। আমি আশা করি, বাংলাদেশ যেন ইতিবাচক বার্তা দেয়, যদিও আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই-একবার বলেছেন। তেমনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কাছ থেকেও ইতিবাচক বার্তা আসবে- সেটা আমি আশা করি। এখন অনেক ইস্যু থাকলেও বরফ গলাতে লিস্ট লম্বা করতে চাই না। যোগাযোগটা আগে ঠিক হোক। ভিসাটা চালু হোক। ব্যবসায় যেন বাধা না থাকে।’
হিন্দুস্তান টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে, ‘বিক্রম মিশ্রির এ সফরটি এমন এক সময়ে হতে চলেছে, যখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে অভূতপূর্ব উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। হিন্দু সংখ্যালঘু ইস্যু এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের পর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কয়েকটি ভারতীয় রাজ্যে বিক্ষোভ হচ্ছে।’
এই মুহূর্তে এই বৈঠকে বাংলাদেশের কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত? এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এর মধ্যে ভারতের মিডিয়া যে নিউজ দিচ্ছে সেটা কিভাবে থামানো যায়। প্রয়োজন হলে ভারতের মিডিয়া টিম বাংলাদেশে আসতে পারে। সেটা পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে না হলেও আলাদাভাবে আসতে পারে- সেই সুযোগটা তৈরি করা। তাহলে যে নেতিবাচক খবর হচ্ছে, সেটা হয়ত থামবে। এটাও সত্যি যে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানতে চাইবেন তাদের কাছে যে তথ্য আছে, আমাদের মিডিয়াতেও এসেছে সংখ্যালঘুরা যে আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন সময়। এটা হয়তো একটা বড় বিষয়। এর সঙ্গে ব্যবসা স্বাভাবিক করার চেষ্টা থাকবে। যেহেতু এটা প্রথম সফর, সেহেতু একাধিক বিষয় থাকবে।’
উত্তেজনা প্রশমনের উপায় জানতে চাইলে জনাব আহমেদ বলেন, ‘দুই দেশেই বিভিন্ন ধরনের ফোর্স থাকে, তারা সুযোগটা নেয়। উপর থেকে যদি বড় আকারে নির্দেশনা না আসে বা তাদের কথায় যদি তৃতীয় ফোর্স উৎসাহ পায়, তাহলে তো এটা থামানো যাবে না। কথাবার্তাটা যদি শুরু হয়, তাহলে দুই দেশই বুঝতে পারবে কোথায় কাজ করা প্রয়োজন। এটা ভারতের জন্য দরকারই। কারণ, তাদের বুঝতে হবে, জনগণের যে আকাঙ্খা, যেটা গত কয়েক বছর ধরে প্রতিফলন হয়নি। আবার তাদের দিক থেকে যে সমালোচনাটা আছে সংখ্যালঘু নিয়ে, সেটাও অ্যাড্রেস করা যেতে পারে। আসলে আলোচনা হলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মাকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায়।
বৈঠক শেষে প্রনয় ভার্মা সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যাবে না। আমরা আমাদের আলোচনা চলমান রাখবো। বৈঠক তারই একটা অংশ। আমাদের বিস্তৃত সম্পর্ক রয়েছে, পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। আমরা একটি ইস্যু দিয়ে সেটি মূল্যায়ন করতে পারবো না। আমাদের পরস্পর-নির্ভরতার বিষয় রয়েছে, যেটি দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বশেষ দুই মাসে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের অনেক ইতিবাচক বিষয় রয়েছে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। একসঙ্গে কাজ করে যাবো।’
বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কিভাবে নিরসন হতে পারে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সম্পর্ক স্থিতিশীল করা এবং এবং উত্তেজনা যাতে না বাড়ে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা। আমাদের চলমান যেসব বিষয় আছে, সেগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা করা। এগুলোই এই মুহুর্তে গুরুত্বপূর্ণ। আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পরষ্পারিক বোঝাপড়া শক্তিশালী করতে পারলেই আমার ধারণা এই ধরনের সমস্যা থাকবে না বা এড়িয়ে চলা সম্ভব।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে