বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে বিভিন্ন ফোরামে নিজেদের মতামত তুলে ধরছেন ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা। আগামী সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের দেশের আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন। একইভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও কূটনীতিকদের সঙ্গে নির্বাচন ইস্যুতে বৈঠক করছেন। প্রতিটি বৈঠকের অধিকাংশ সময়জুড়ে আগামী নির্বাচন কেমন হতে পারে, কোন দলের কৌশল কী হবে, কোন পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করছেন কূটনীতিকরা।
কূটনৈতিক ও দলীয় সূত্র জানায়, এসব বৈঠকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কূটনীতিকদের আহ্বান জানাচ্ছেন, তারা যেন আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ভূমিকা রাখেন।
কিন্তু নির্বাচনে বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ আসুক, সরকার তা চায় না। অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কূটনীতিকরা সীমা লঙ্ঘন করলে সতর্ক করার সিদ্ধান্তও রয়েছে ঢাকার। অতীতে বাংলাদেশের নির্বাচন ও অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুতে বিদেশিদের উৎসাহ দেখা গেছে। নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বললেও তারা বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন, সহযোগিতার প্রস্তাবও রাখছেন। সরকার চাইলে সহায়তা দেওয়া হবে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি জিন লুইস একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যত বেশি সংলাপ হবে, সংঘাত ততই কমে আসবে। এটিই আদর্শ। তাই যে কোনো সংলাপে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে সবাইকে স্থিতিশীল পরিবেশ রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছি। আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে এখনো আমাদের তেমন কোনো ম্যান্ডেট নেই। কারণ বাংলাদেশ সরকার এমন কিছু চায়নি। বিরোধীরা চাইলেই হবে না।’
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া বিএনপির রাজনৈতিক দৈন্যের বহির্প্রকাশ।’ বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে ‘কোনো ক্ষমতাধর দেশেরও কিছু করার নেই’ বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা।
এদিকে ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের পেশাগত ‘শিষ্টাচার ও রীতিনীতি’ মেনে চলার তাগিদ দেয় সরকার। ঢাকার সব দূতাবাস, জাতিসংঘ কার্যালয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে গত ১৮ জুলাই এ সংক্রান্ত অভিন্ন ‘নোট ভারবাল’ পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আমরা সবাইকে সম্মানের সঙ্গে এটা স্মরণ করাতে চাই, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বা কাজে কূটনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তদের ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন এবং ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার নীতি পুরোপুরি মেনে চলা উচিত। নোট ভারবাল পাঠানোর আগে এবং পরে একাধিকবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বিদেশিদের তৎপরতায় উষ্মা প্রকাশ করেন।
ইউরোপী ইউনিয়নের (ইইউ) ১০ দেশের রাষ্ট্রদূত গত ২ অক্টোবর বৈঠকে বসেছিলেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির সঙ্গে। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের পর ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এক টুইটে ছবি যুক্ত করে বলেছেন, মিশনপ্রধানরা ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের নিয়মিত বৈঠকগুলো চালিয়ে যাচ্ছেন’ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে জানার জন্য। জাতীয় পার্টির দলীয় সূত্র জানায়, সে বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট) ওয়েন্ডি শারম্যান বৈঠক করেন। বৈঠকের পরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক বিবৃতিতে বলেন, শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয়। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়, এটি সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের। সহিংস রাজনৈতিক অবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয় এবং আগামী নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনিটরিং করবে।
গত ৩ অক্টোবর সোমবার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হোমসের মন্দিরে দুর্গাপূজা পরিদর্শনে গিয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ব্রিটেন। চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগমুক্ত নয় তারা। তবে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে কোনো ধরনের সহিংসতা নয়; বরং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখতে চান তারা। একই দিন সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের নির্বাচন হবে, তা অবশ্যই এ দেশের জনগণ নির্ধারণ করবে। তবে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্য আগামীতে একটি ভালো নির্বাচন প্রত্যাশা করে।
যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে না ভারত, তবে বাংলাদেশে কোনো ধরনের অস্থিরতা দেখতে চায় না প্রতিবেশী দেশটি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সদ্য বিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চায় ভারত সরকার। তিনি বলেন, এ দেশের নির্বাচন নিয়ে নাক গলাবে না নয়াদিল্লি। বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে ভারতে তার প্রভাব পড়ে। নিজেদের স্বার্থেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় তারা।
গত ৭ সেপ্টেম্বর বুধবার দুপুরে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার তার বাসায় বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে যুক্তরাজ্য হাইকমিশন ফেসবুকে এবং রবার্ট ডিকসন টুইট বার্তায় বলেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিষয়ে তারা আলোচনা করেছেন। যুক্তরাজ্য রাজনৈতিক দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সহিংসতায়, বিশেষ করে ভোলা ও নারায়ণগঞ্জে তিন বিএনপি কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় খুবই উদ্বিগ্ন। সূত্র জানায়, বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়েও কথা হয় বিএনপি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের সঙ্গে ৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষাৎ করেন অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নার্দিয়া সিম্পসন। এ সময় রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেন তারা। জাতীয় পার্টি একটি বিবৃতিতে বলে, দুপুরে জিএম কাদেরের উত্তরার বাসভবনে তারা বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে তারা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর গুলশান বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির সঙ্গে বিএনপি বৈঠক করে। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিএনপির তরফে জানানো হয়। তবে জাপানের পক্ষ থেকে বৈঠক নিয়ে কোনো মন্তব্য আসেনি। গত ১৩ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এবং ১২ জুলাই জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইস বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে গিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অবশ্য দুটি সাক্ষাতের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপরে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
গত ৩ জুলাই বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাইকমিশনের নেতৃত্বে অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৪টি দেশের রাষ্ট্রদূত যান ইসিতে। ১৪টি দেশের মধ্যে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, তুরস্ক এবং জাপানের রাষ্ট্রদূত ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে তারা আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু দেখতে চায় বলে জানিয়েছে। এ জন্য তারা নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
এদিকে ৭ জুন ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, আগামী বছরের শেষে নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যম প্রতিদিন খবর প্রচার করছে। নির্বাচনের ব্যাপারে আমি সরকারের দিক থেকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। আমি আশা করব, গতবারের তুলনায় এবার ভালো, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার পদক্ষেপ নেবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তারা উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের মন্তব্য ও কূটনীতিকদের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর ধরনা দেয়ার ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুুল মোমেন বলেন, ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তির কারণে এখনো আমরা বিদেশি কিছু হলে পছন্দ করি। সে কারণে তাদের কাছে ধরনা দিই। এ অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন করার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা চেষ্টা করছি একটা লোকও যেন মারা না যায়। বিদেশি কূটনীতিকদের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করা নিয়ে সরকার বিবৃতিতে বা প্রতিবাদ জানাতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি আমাদের দেশে যারা ডিপ্লোম্যাট আছেন, তারা পরিপক্ব। তারা সম্মানিত লোক। তারা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।’