গত ১৫ বছরে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা কাজের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা করছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে সরকারি হাইস্কুল ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে। তাদের মধ্যে বেশকিছু শিক্ষক আছেন, যারা বিগত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগপ্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে ভোটকেন্দ্রে থেকে কারচুপিসহ নানা অনিয়মে সহযোগিতা করেছেন। অনেককেই প্রকাশ্যে নির্দিষ্ট প্রতীকে সিল মারতেও দেখা গেছে। ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা কিছু শিক্ষক ছিলেন যারা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পদধারীও। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিতর্কিত এসব শিক্ষককে চিহ্নিত করছে বিএনপি। এ তালিকা তৈরি করে উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। যাতে করে বিতর্কিত এ শিক্ষকদের ভোটার তালিকা প্রস্তুত বা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রাখা না হয়।
গত মঙ্গলবার বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে এ তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ৯ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, এক বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির একাধিক নেতা জানান, বৈঠকের মূল এজেন্ডায় ছিল ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের নেওয়া হলে তা চিহ্নিত করে তালিকা করা। ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য যেসব শিক্ষক বা অন্যদের তালিকা নির্বাচন কমিশন করেছে, তাদের এখন প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। এ তালিকা ধরেই মূলত পরে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় তাদের ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাই এখানে বিতর্কিত লোক আছে কিনা, দুর্নীতিবাজ শিক্ষক বা দুর্নীতিবাজ কেউ আছে কিনা, তা চিহ্নিত করার জন্য তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কারণ ইতোমধ্যে বিএনপির কেন্দ্রকে স্থানীয় অনেক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, যারা বিগত সরকারের আমলে নির্বাচনগুলোর সঙ্গে জড়িত থেকে বিতর্কিত কাজ করেছেন, তাদের অনেকে এই ভোটার তালিকা হালনাগাদের তালিকায় রয়েছেন। এ জন্য সব উপজেলা ও ইউনিয়নের নেতারা স্থানীয়ভাবে খসড়া তলিকা সংগ্রহ করবেন। এর পর দেখবেন বিগত নির্বাচনে যেসব বিতর্কিত লোকরা জড়িত ছিলেন, তারা আছেন কিনা। তাদের চিহ্নিত করে তা উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে জমা দেওয়া হবে। যাতে বিতর্কিতদের ভোটার তালিকা হালনাগাদের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয় এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য তালিকাভুক্ত না করা হয়।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, গত মঙ্গলবার বৈঠকের পরই দলের নির্দেশনা অনুযায়ী তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা এ কার্যক্রম শুরু করেছেন।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার যোগ্য নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ শুরু হচ্ছে আগামী ২০ জানুয়ারি। নির্বাচন কমিশনের নিয়োজিত তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজাররা দুই সপ্তাহ ধরে ভোটার যোগ্যদের তথ্য নেওয়া, মৃতদের বাদ দেওয়া ও যাচাইয়ের কাজ করবেন। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করে। এতে বলা হয়, নতুন ও বাদ পড়াদের তথ্য সংগ্রহ ও বিদ্যমান তালিকা থেকে মৃতদের বাদ দেওয়ার জন্য সারাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য নেওয়া হবে ২০ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত; নিবন্ধন কেন্দ্রে বায়োমেট্রিক নেওয়া হবে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত থানা নির্বাচন কার্যালয়ে ভোটার এলাকা স্থানান্তরের আবেদন গ্রহণ, মৃতদের নাম কর্তন ও নতুন ভোটারের তথ্য ডেটা এন্ট্রি, আপলোড এবং ৫ মে এনআইডি উইং খসড়া তালিকার জন্য পিডিএফ প্রস্তুতের কাজ করবে। এ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে গত বছরের ভোটার তালিকা চূড়ান্তের আগেই নতুন হালনাগাদ কাজ শুরু হলো।
বৈঠকে সারাদেশের মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌর ও ইউনিয়নের কমিটি গঠনের কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। কাউন্সিলের মাধ্যমে এসব কমিটি করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলেও বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল বলেন, বৈঠকে সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেসব কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে এবং যেসব কমিটি এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি, সেগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য বলা হয়েছে। তবে সব জেলা ও মহানগর কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে করতে হবে। যেসব সাংগঠনিক জেলার আহ্বায়ক কমিটি আছে, সেই জেলায় যেসব ইউনিট কমিটি যেমন থানা-উপজেলা বা পৌর- এসব কমিটি যদি না হয়ে থাকে, তা দ্রুত করতে হবে। পরে সম্মেলনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জেলার কমিটি গঠন হবে।
এ দিকে গত বছরের ২৬ নভেম্বর বিএনপির কেন্দ্র থেকে চিঠিতে ৩ মাসের মধ্যে সব পূর্ণাঙ্গ কমিটি শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ জন্য ঢাকা ছাড়া নয়টি সাংগঠনিক বিভাগে ৯ সিনিয়র নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বেঁধে দেওয়া তিন মাসের মধ্যে দেড় মাস ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। জানা গেছে, এর মধ্যে নাটোর, কুমিল্লা (দক্ষিণ) ও শেরপুরসহ কয়েকটি জেলা কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে খুলনা, মাগুরা ও মেহেরপুর জেলাসহ আরও কয়েকটি। এ ছাড়া জেলা কমিটির অধীনে থাকা বেশ কয়েকটি ইউনিট কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভাগীয় জেলা ও ইউনিটের কমিটি গঠনে জোরেশোরে কাজ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এ জন্য তারা অধিকাংশ সময়ই জেলা সফর করে সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও করছেন।
রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম বলেন, কমিটি গঠনের কাজ পুরোদমে চলছে। ইউনিট কমিটি গঠনের পর সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠন করা হবে। সে জন্য জেলার ইউনিট কমিটিগুলো গঠনের কাজ করছি। ইতোমধ্যে অনেক ইউনিটে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে।