দেশের শ্রমবাজারে কর্মদক্ষতার ঘাটতি প্রায় ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, তৈরি পোশাক ও হালকা প্রকৌশল শিল্পে উচ্চপর্যায়ে দক্ষ লোকের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। কোথায় অষ্টম শ্রেণি পাস কর্মীর দরকার হলে দরখাস্ত আসছে মাস্টার্স পাসের; কিন্তু দক্ষ লোকের অভাব। আবার কোথাও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দরকার হলে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দক্ষতা ঘাটতি ৭১ শতাংশ। আবার ভার্টিক্যাল মিসম্যাচ (চাকরি প্রার্থীদের অযোগ্যতা) হিসাব করলে দক্ষতার ঘাটতি দাঁড়ায় ৮৩ শতাংশ। যত ওপরের দিকে ওঠা যায়, দক্ষতার ঘাটতি তত বেশি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। ‘লেবার মার্কেট স্টাডিজ ফর এসইআইপি অন স্কিল ডিমান্ড, সাপ্লাই অ্যান্ড মিসম্যাচ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বিআইডিএস। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ (এসইআইপি) প্রকল্পের সহযোগিতায় গবেষণা করা হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল রবিবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, দেশের শ্রমবাজারের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যাপক দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, যা ৩০ শতাংশ। তবে খাতভিত্তিক এ সংখ্যা আলাদা। দক্ষতার ব্যাপক ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কিছু ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ থাকলেও তা মানসম্মত বা বর্তমান চাহিদাকে পূরণ করে না। বিশেষ করে মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের কর্মের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি আরও অনেক বেশি। ফলে পোশাকশিল্পে এদেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশি শ্রমিকদের পেছনে চলে যাচ্ছে। এজন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে শ্রমিকদের কর্ম সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ এমদাদউল্লাহ মিয়ান এবং ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (এনএসডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরিন আফরোজ।
আলোচক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, নির্বাহী প্রকল্প পরিচালক ইখলাসুর রহমান, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান উদ্ভাবন কর্মকর্তা তাপস কুমার মজুমদার, প্রাণ-আরএফএলের করপোরেট পরিচালক (অর্থায়ন) উজমা চৌধুরী এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) নীতি পরামর্শক আনির চৌধুরী। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. কাজী ইকবাল।
মূল প্রবন্ধে কাজী ইকবাল বলেন, শ্রমবজারে মিসম্যাচ বলতে বলা হয়েছে, যে পরিমাণ দক্ষ শ্রমিক দরকার তা পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ম্যানেজার ও পেশাদারদের মধ্যে এই ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, শ্রমিকদের কর্মক্ষমতায় বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশের একটি। এক্ষেত্রে সবার ওপরে অবস্থানে সিঙ্গাপুর আর বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে চতুর্থ। অর্থাৎ কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। এ ছাড়া ভারত, শ্রীলংকা, মঙ্গোলিয়াসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। গত এক বছরে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পেয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক।
ড. বিনায়ক সেন বলেন, শ্রমবাজারে সঠিক মজুরি প্রশিক্ষণের আকাক্সক্ষাকে বাড়িয়ে দেয়। শ্রমবাজারে মজুরির সঙ্গে প্রশিক্ষণকে মেলাতে হবে। আগামী ১০ বছরে শ্রমিকের যে চাহিদা হবে, সে অনুযায়ী এখন থেকে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ ছাড়া বিদেশি শ্রমিকদের আরও দক্ষ করে পাঠাতে হবে। তা না হলে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে টেকসই উন্নয়নে পিছিয়ে পড়বে দেশ।
বক্তারা বলেন, শিল্পকারখানায় অদক্ষ শ্রমিক যেমন উৎপাদনশীলতা কমাচ্ছে, তেমনি প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে তারা খাপ খাওয়াতে পারছে না। ফলে একসময় মধ্যম আয়ের ফাঁদের মতো নিম্ন উৎপাদনশীলতার ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের। এসব সমস্যা সমাধানে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ভোকেশনাল শিক্ষাকে যাতে সামাজিকভাবে ছোট করে দেখা না হয়, সেজন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সুশাসনের আগে উন্নয়ন জরুরি। তবে সুশাসনের বিষয়টিও নিশ্চিত করা দরকার। কেননা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দুবেলা খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং সঠিক বিচার চায়। এগুলো থাকলেই তারা খুশি। এজন্য আগে উন্নয়ন করতে হবে।