দায়িত্বে অবহেলা, ঘুস গ্রহণ ও শুল্ক ফাঁকিতে সহায়তা করায় কাস্টমসের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তাদের কাউকে বেতন ধাপ অবনমন করা হয়েছে। আবার কাউকে তিরস্কার অথবা চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গত দুই বছরে দেওয়া হয়েছে এসব শাস্তি। এছাড়া আরও অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চলছে বিভাগীয় তদন্ত। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঘুসখোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না গেলে ঘুসের চিত্র বদলানো সম্ভব নয়। শাস্তিস্বরূপ যেই পরিমাণ বেতন কমানো হয়, সেই পরিমাণ অর্থ ঘুসখোর কর্মকর্তাদের ‘মিনিটের কামাই’।
ব্যবসায়ীদের আরও অভিমত-দুর্নীতির তদন্ত পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা দরকার। কাস্টমস কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত কাস্টমস কর্মকর্তাদের দিয়ে না করিয়ে অন্য ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের দিয়ে করালে তদন্তের নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা দুটোই বাড়বে। এখন কাস্টমস কর্মকর্তার তদন্ত কাস্টমস কর্মকর্তারা করার কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বিলম্ব করা হয়। এতে অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বরে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। ওই সভায় আয়কর ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের চলমান বিভাগীয় মামলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যান সব বিভাগীয় মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে আলোচিত দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) কর্মকর্তাদের (প্রশাসন ক্যাডার) দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
গত ২ বছরে সাজাপ্রাপ্ত কাস্টমস কর্মকর্তাদের তালিকা করেছে এনবিআরে। তালিকা অনুযায়ী, রাজস্ব আহরণের নামে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের মামলা, জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে অবৈধভাবে কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ ও আত্মসাতের অভিযোগে উপকমিশনার জাহিদুল ইসলামকে ‘তিরস্কার’ দণ্ড দেওয়া হয়। অসদাচরণ ও পলায়নের অভিযোগে আরেক উপকমিশনার শামীমুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ছুটি না নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় সহকারী কমিশনার মৌসুমী সরকারের বেতন এক ধাপ অবনমিত করা হয়েছে। রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে জড়িত থাকায় সহকারী কমিশনার নুরের জামানের বেতন ৩ ধাপ অবনমন করা হয়েছে। শুল্ক ফাঁকিতে সহায়তার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় রাজস্ব কর্মকর্তা মুহাম্মদ মামুন মিয়া সরকারের বেতন ২ ধাপ অবনমন করা হয়েছে।
কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহম্মেদ ও আজাদ হোসেন হাজারীকে চাকরি থেকে অপসারণ এবং মমিনুর রহমান ভুঁইয়ার বেতন ৩ ধাপ অবনমন করা হয়েছে। রাজস্ব আহরণের নামে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের মামলা, জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে অবৈধভাবে কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ ও আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় হাসিবুল ইসলামের বেতন এক ধাপ অবনমন এবং একই অভিযোগে মেহরাব আলীকে তিরস্কার করা হয়েছে। বদলিকৃত স্থানে যোগদান না করায় রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল হাশেমকে চাকরি থেকে অপসারণের জন্য সরকারি কর্মকমিশনে মতামত দেওয়ার জন্য কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলার জন্য আবুল কালাম হাওলাদারের বেতন ৩ ধাপ অবনমন করা হয়েছে।
আরও জানা গেছে, বেনাপোল কাস্টমসে স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা চুরির ঘটনায় সহকারী কমিশনার কল্যাণ মিত্র চাকমার তদন্ত চলমান। একই ঘটনায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বিশ্বনাথ কুন্ডু, শাহিদুল সরদার, সিদ্দিকুর রহমান, আর্শাদ হোসাইন, শহিদুল ইসলাম মৃধা, রিপন কান্তি ধর, অলিউল্লাহ ও আবদুল আউয়াল মজুমদারকে সায়মিক বরখাস্ত করা হয়েছে। পানগাঁও কাস্টমসে শুল্ক ফাঁকিতে সহায়তা করায় রাজস্ব কর্মকর্তা শ্যামল কুমার বিশ্বাস, ফরিদ উদ্দিনের বেতন তিন ধাপ অবনমন এবং একই ঘটনায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাব্বির হোসেনের বেতন দুই ধাপ অবনমন করা হয়। ভুল এইচএস কোড এবং সিপিসিতে শুল্কায়ন করায় রাজস্ব কর্মকর্তা বাসুদেব পাল ও জমির উদ্দিনকে তিরস্কার করা হয়। শুল্ক ফাঁকিতে সহায়তার অভিযোগে রাজস্ব কর্মকর্তা নাছির উদ্দিনের বেতন তিন ধাপ অবনমন এবং একই ঘটনায় রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল কাশেম খানকে তিরস্কার করা হয়। এছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় রাজস্ব কর্মকর্তা ফেরদৌস মোহাম্মদ দুলালকে তিরস্কার করা হয়েছে। এছাড়া কায়িক পরীক্ষায় গাফিলতি প্রমাণিত হওয়ায় বিপিন চাকমা ও মাহমুদুল হাসান খানের বেতন তিন ধাপ অবনমন করা হয়েছে। একই অভিযোগে মাধব চন্দ্র ও আতিকুর রহমানের বেতন এক ধাপ অবনমন করা হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাজা প্রদান ইতিবাচক, প্রশংসনীয়। তবে এসব ক্ষেত্রে বিভাগীয় শাস্তি পর্যাপ্ত বা পুরোপুরি কার্যকর নয়। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় এনবিআর সাজাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ দুদকের মাধ্যমে অনুসন্ধান বা অধিকতর তদন্ত করাতে পারে। তাহলে দুর্নীতি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে সব আমদানি-রপ্তানিকারকরা জিম্মি। ঘুস-বকশিশ ছাড়া একটি ফাইলও টেবিল থেকে নড়ে না। চাহিদামাফিক ঘুস না দিলে পণ্যের এইচএস কোড ঠিক নেই, পণ্যের সঙ্গে বিবরণে মিল পাওয়া যায়নিসহ নানা ছুতায় হয়রানি করা হয়। সবকিছু ঠিক থাকলেও নমুনা রাসায়নিক টেস্টের নামে হয়রানি করা হয়। ভ্যাটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ঘুস না দিলে খাতাপত্র জব্দ করে নিয়ে মনগড়া কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিআইএন লক, এমনকি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এসব হয়রানির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ঘুসখোরদের উত্তর হচ্ছে ‘রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে’ তারা এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে। হয়রানি থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়েই ঘুস দিতে হয়। ঘুসের জন্য ভ্যাট-কাস্টমসের ঘাটে ঘাটে ফাঁদ তৈরি করা আছে। এ ফাঁদ থেকে বেরোনোর সাধ্য কারও নেই।
এ বিষয়ে নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঘুস গ্রহণ, হয়রানি বা দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি হিসাবে বেতন ধাপ অবনমন করা হলে অনিয়ম-দুর্নীতি কখনোই বন্ধ হবে না। কাস্টমসের নিচের দিকের কর্মকর্তারাও (সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা/রাজস্ব কর্মকর্তা) প্রতিদিন যে অর্থ কামান, তাতে তাদের বেতনের প্রয়োজন পড়ার কথা নয়।
তিনি আরও বলেন, অনেক উচ্চপদস্থ আমলা বা সংসদ-সদস্য ব্যবসায়ীদের বলেন, ব্যবসায়ীরা কেন ঘুস দেয়। ঘুস না দিলে কর্মকর্তারা ফাইলে এমন প্যাঁচ দেয়, যাতে কাস্টমস কমিশনাররাও অসহায় হয়ে পড়ে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা উপকার করতে পারে না। অবশ্য বর্তমানে ঢাকা বন্ড কমিশনারেটের চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। দুই কমিশনারই হয়রানি-ভোগান্তি কমিয়ে আনতে কাজ করছে। এজন্য এনবিআরের সর্বোচ্চ মহলের সাপোর্ট তাদের দিতে হবে। আমরাও আমাদের জায়গা থেকে সহায়তা দেব।