বদলে যাচ্ছে পর্যটন শহর কক্সবাজার। পর্যটক নিয়ে এখন ট্রেন ছুটবে সৈকত শহরে। চলতি বছর জাতীয় গ্রিডে মিলবে মহেশখালীর মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ আর গভীর সমুদ্রের জ্বালানি তেল খালাসের আধুনিক পদ্ধতি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
কক্সবাজারকে আমূল বদলে দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার ১৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন। প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে এসব প্রকল্প। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা ও দলীয় জনসভাকে ঘিরে চলছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও প্রস্তুতি।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ স্থাপন একসময় স্বপ্নই ছিল। অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। অল্প ব্যয়ে ট্রেনে দ্রুত সময়ে যাতায়াত করা যাবে সাগরকন্যার কাছে। রেল চালু হওয়ায় পর্যটক যাতায়াত সহজ হওয়ার পাশাপাশি কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহনও করা যাবে। কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন- এমনটিই মনে করছেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, কয়েকটি মেগা প্রকল্পসহ ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং চারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন হতে যাওয়া প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৯টি বড় প্রকল্প আর ছয়টি ছোট প্রকল্প। এর মধ্যে রয়েছে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন, মাতারবাড়ীর আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেল, বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত সেতু, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কুতুবদিয়া দ্বীপকে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তকরণ, উখিয়ার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, রামু উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চকরিয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুল হামিদ পৌর বাস টার্মিনালের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ, কুতুবদিয়া ঠাণ্ডা চৌকিদারপাড়া আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, মহেশখালীর গোরকঘাটা-শাপলাপুরের জনতাবাজার সড়ক, বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমি ভরাট, বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প, ঈদগাঁও জাহানারা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, মহেশখালীর ইউনুছখালীর উচ্চবিদ্যালয়, উখিয়ার রতœা ও মরিচ্যা পালং উচ্চবিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন।
অন্য দিকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হতে যাওয়া প্রকল্পগুলো হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেলের ১ম টার্মিনাল, টেকনাফের মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার রিসিলেন্ট শেল্টার কাম আইসোলেশন সেন্টার, রামুর জোয়ারিয়ানালার নন্দাখালী সড়কে আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় কাব স্কাউটিং সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণ।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ঝিলংজায় ২৯ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে চোখধাঁধানো আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা। পুরো স্টেশনের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চার পাশে ব্যবহার করা হয়েছে কাচ। ছাদের ওপর ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক স্টিল ক্যানোফি। ফলে দিনের বেলা বাড়তি আলো ব্যবহার করতে হবে না স্টেশনে। আর অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলীর কারণেই একে বলা হচ্ছে গ্রিন স্টেশন।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্প পরিচালক মো: সুবক্তগীন বলেন, স্টেশনে ফুড কোর্ট, হোটেল ও শপিং কমপ্লেক্সের বিষয়টি বাইরের এজেন্সি দ্বারা পরিচালনা করা হবে। ছয়তলার এই স্টেশনে রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি, মালামাল রাখার লকার, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমলসহ আধুনিক সব সুবিধা। ৪৬ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতাসংবলিত এই স্টেশনটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। যেখানে আছে কনভেনশন হল, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, এটিএম বুথ, প্রার্থনার স্থানসহ নানা সুবিধা।
বহুল প্রত্যাশিত এই রেল প্রকল্প আজ উদ্বোধন হচ্ছে। এর আগে গত ৫ নভেম্বর পরীক্ষামূলক ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এবং কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম চলাচল করে। এর পরই চট্টগ্রাম থেকে ৭ নভেম্বর ১৬টি বগি নিয়ে একটি স্পেশাল ট্রেন কক্সবাজার পৌঁছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে রাজধানী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি চলছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
জানা গেছে, যৌথ অর্ধায়নে দোহাজারী-কক্সবাজার ভায়া ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাক। দেশের বহুল প্রত্যাশিত ও দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প সিঙ্গেল ট্র্যাক ডাবলগ্যাজ (মিটারগ্যাজ বা এমজি যার প্রতি এক্সেলে লোড ক্যাপাসিটি হবে ১৫ মেট্রিকটন আর ব্রডগ্যাজ বা বিজি যার প্রতি এক্সেল লোড ক্যাপাসিটি হবে প্রায় ২৫ মেট্রিকটন)। এ দিকে প্রায় শত বছরের পুরনো কালুর সেতুর ওপর নির্মিত মিটারগ্যাজ রেলওয়ে লাইনের লোড ক্যাপাসিটি বৃদ্ধিসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে (ওয়াকওয়ে ছাড়া)।
জেলা প্রশাসন ও দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের উত্তর জানারঘোনা এলাকায় স্থাপিত আন্তর্জাতিকমানের আইকনিক রেলস্টেশনে আয়োজিত সুধী সমাবেশে যোগ দেবেন। এতে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া এসব উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ঘোষণা দেয়ার কথা রয়েছে। এরপর ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঝিনুকের আদলে তৈরি নান্দনিক সৌন্দর্যের এ স্টেশন এবং রেল চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। এরপর বিকেলে মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের পর স্বাধীনতাত্তোর ৫০ বছরে কয়েক প্রজন্মের স্বপ্ন ছিল দোহাজারী পর্যন্ত আসা রেললাইন এক দিন কক্সবাজার পৌঁছাবে। দেখা মিলবে স্বপ্নের সেই ট্রেনের। এত দিন সেই অধরা স্বপ্নের পূর্ণ হতে যাচ্ছে কক্সবাজারবাসীর। কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা জানান, সরকারের এসব উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেবে।
এ দিকে প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফরকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তাসহ সার্বিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর হতে যাওয়া প্রকল্পগুলোসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় বাস্তবায়নাধীন রয়েছে ৫৩টির বেশি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। এদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পও। এসব প্রকল্পের ব্যয় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি।