বাংলাদেশের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো নির্দেশনায় ওয়াজ মাহফিলে রাজনৈতিক ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক বৈঠকে এ তথ্য দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকেই।
তবে ইসলামি বক্তারা বলছেন, রাজনৈতিক নেতাদেরও ওয়াজের মঞ্চে এসে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া উচিত নয় এবং ওয়াজের বিষয়ে বাধা নিষেধ আরোপ না করে আলেমদের সহায়তা নিয়ে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বুধবার সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে যে, “আসন্ন শীত মৌসুমে ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখার বিষয়ে পুলিশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সব ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে”।
এর আগে, এই কমিটির বৈঠক থেকেই এ ধরনের নির্দেশনা দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো। সে পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে সেটি সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে জানানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
সংসদীয় কমিটির সদস্য মোকাব্বির খান বলছেন, অনেক সময় ছোটো একটি কথা কিংবা কোনো কথা গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এবং সে কারণে শুরুতেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে কিছু ইসলামী বক্তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ উঠছে।ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চ থেকেই হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বিরোধী বক্তব্য দিয়েছিলেন। দু’হাজার একুশ সালের এপ্রিলে বিভিন্ন অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছিলো এবং তিনি এখনো জেলেই আছেন। আবার কিছু বক্তার বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে যেখানে তারা নারীদের নিয়ে অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন এমন অভিযোগ উঠেছে। এর আগে গত বছর জানুয়ারিতেও ওয়াজ মাহফিলের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিলো।
সাধারণ ওয়াজ মাহফিলের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে আয়োজকদের অনুমতি নিতে হয়।
‘আলেমদের হাতেই এগুলো ছেড়ে দেয়া উচিত’
ঢাকাসহ সারাদেশে ওয়াজ করেন ইসলামি বক্তা হাবিবুর রহমান মিসবাহ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন, ওয়াজ মাহফিলের বক্তৃতায় কোনো বিধি নিষেধ আরোপ না করে কর্তৃপক্ষের উচিত আলেমদের সাথে আলোচনা করে এটি আলেমদের ওপরই ছেড়ে দেয়া।
“সরকার যদি মনে করি কেউ অসংলগ্ন কিছু বলছে সেক্ষেত্রে আলেমদের মাধ্যমেই ব্যবস্থা নেয়া যায়। তাদের তত্ত্বাবধানে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা হলে কোনো সমস্যা হবে না,” বলছিলেন তিনি।
তার মতে ইসলামি বক্তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণ এলে বা ইসলাম অবমাননা হলে তার প্রতিবাদ করবেন এটাই স্বাভাবিক এবং সেটি রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক বিষয় নয়।
হাবিবুর রহমান মিসবাহ বলছেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন রাজনৈতিক নেতারা এসে ওয়াজের মঞ্চে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন।
“ওয়াজের মঞ্চে কারও কোনো অসংলগ্ন বক্তব্য দেয়া যেমন অনুচিত তেমনি কোনো রাজনৈতিক নেতারও এ ধরণের মঞ্চে এসে বক্তব্য দেয়া উচিত না। উভয়পক্ষ সংযত হলেই পরিবেশ সুন্দর হবে ও কোনো প্রশ্ন উঠবে না,” বলছিলেন তিনি।
আরেকজন ইসলামি বক্তা আজিজুল হক মাদানি বিবিসি বাংলাকে বলছেন এসব বিষয়ে সরকারকে বলতে হবে কেন যেখানে ওয়াজের কাজ হলো ইসলামের দাওয়াত দেয়া।
“এখানে তো উগ্র বা বিদ্বেষমূলক কথাবার্তার কোনো সুযোগই নেই। সেটা সবাইকে বুঝতে হবে। আবার ধর্মের কথা কীভাবে বলা হবে সেটা সরকারেরও বলে দেয়ার কিছু নেই,” বলছিলেন তিনি।
‘রাজনৈতিক, বিতর্কিত এবং উস্কানিমূলক’ বক্তাদের ওপর ‘নজরদারি’
দু’হাজার একুশ সালের জানুয়ারিতে কয়েকজন ইসলামি বক্তা অভিযোগ করেছিলেন যে ওয়াজ মাহফিল করার সময় তাদের গোয়েন্দা সংস্থার কড়া নজরদারিতে রাখা হয়।
এর প্রেক্ষাপটে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন যে, ওয়াজ করার সময় কিছু বক্তা রাজনৈতিক, বিতর্কিত এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এমন বক্তাদেরই শুধু নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে।
এমন ১৫জন বক্তাকে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিহ্নিত করেছিলো বলে জানানো হয়েছিলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও এ ধরনের অভিযোগ তখন এসেছিলো। ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো যে ওয়াজ মাহফিলে কিছু বক্তা নারী অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্বেষ ও হিংসা ছাড়াচ্ছেন। অনেকে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদে উৎসাহ দিচ্ছেন।এর আগে ২০১৬ সালে তিনজন ইসলামি বক্তাকে ওয়াজ মাহফিলে অংশ নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো কুমিল্লা জেলা প্রশাসন।
তাদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক এবং উগ্রবাদকে উৎসাহ দেয় এমন বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ ছিলো।
BBC