না ফেরার দেশে চলে গেছেন রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী সাদি মহম্মদ। তার স্বেচ্ছামৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না শিল্পীরা। কয়েকজনের প্রতিক্রিয়ায় উঠে এসেছে সাদির বেদনার বিদায়ের কথা…
আমাদের কাম্য ছিল না এটা। আমরা কখনো ভাবিনি সাদি মহম্মদ এভাবে চলে যাবে। তার এই চলে যাওয়ায় আমরা আতঙ্কিত ও শোকাহত। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার সেই ভরা গলা, দরাজ কণ্ঠের গান আর কোথায় পাব? কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? সাদি যা করেছিল, দিয়েছিল আমাদের, সে তুলনায় আমরা তার প্রতিদান দিতে পারিনি। সেই সত্তর দশকের শেষ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫ বছরের মতো কাজ করে গেছে সে। মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলা সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, দেশাত্মবোধক, এসবের প্রতি তার যে মমতা, নিবেদন, শ্রম, চর্চা; সবকিছু মিলে সাদি একজন অনন্য মানুষ।
পাঁচ দিন শান্তিনিকেতনে থেকে সবে ঢাকায় ফিরেছি। ফিরেই এমন খবর শুনব, তা ভাবিনি। খবরটি শুনেই তার বাসায় ছুটে গিয়েছি। তাকে নিয়ে আপাতত কিছু বলতে পারছি না। শুধু বলব, আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। যে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তার এমন চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
কী শুনলাম! সাদি ভাই নেই! সব সময় ভালো ব্যবহারে আর কথার মিষ্টতায় মন খুশি করে রাখতেন সবার সঙ্গে, দেখা হলেই। সে মানুষটি সে চলে গেলেন, না ফেরার দেশে স্বেচ্ছা মৃত্যুতে! এমন কোনো সময় সেভাবে দেখিনি, যেখানে অনেক কিছু চাই তার, সম্মানটুকু ছাড়া! খুব সাধারণ একজন অভিমানী শিল্পী। শিল্পীর অভিমান তো থাকবেই, সেটাই তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু অভিমান করে শুধু কষ্টই বাড়ে, বাড়ে বিষণ্নতা! সে বিষয়টা তিনি হয়তো মানতে পারেননি। বহুবার বলেছি অভিমান করেন না। কিন্তু একাকী অভিমানের ওজন, এতটাই হয়তো বেড়ে গিয়েছিল, পারলেন না আর সেই দৌড়ে নিজেকে বাঁচাতে! আত্মহননের পথ বেছে নিলেন! কেন? অভিমান, কষ্ট থেকে পরিত্রাণের এ পথ তো বেছে নেওয়া ঠিক হলো না সাদি ভাই! হারালাম আমরা দরদি কণ্ঠের সাদি মহম্মদকে যার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ভিন্ন এক মাত্রা পেয়েছিল। খুব সচেতন হয়ে গান গাইতেন। গান গাইতেন ভালোবেসে। আমাকে সুমাকে খুব ভালোবাসতেন। সাদি ভাই, অনেক কান্না পাচ্ছেÑ আপনার চলে যাওয়ায়! আল্লাহ যেন তাকে মাফ করে দেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
ছোটবেলা থেকেই সাদি ভাইকে চিনতাম একজন বিনয়ী সংগীতশিল্পী এবং দরাজ কণ্ঠের অধিকারী হিসেবে। যদিও শিবলী ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল আমার বেশি। কিন্তু সাদি ভাইয়ের গানের ভক্ত ছিলাম। হেমন্ত মুখার্জীর মতোন গলা ছিল তার। ভারত ও বাংলাদেশে ওনার ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশে এত দরাজ কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিল বিরল। প্রচ্ছদ অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সাদি ভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়। খ. ম. হারুন ভাইয়ের প্রযোজনায় ও আসাদ চৌধুরীর উপস্থাপনায় প্রচ্ছদ অনুষ্ঠানে আমরা একবার আউটডোর শুটিংয়ে একসঙ্গে গিয়েছিলাম সাদি ভাই গেয়েছিলেন ‘প্রান্তরের ওই গান আমার’, আর আমি ‘মৌ বনে আজ মৌ জমেছে’। ওই দিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল তাই সাদি ভাই অনেক বিরক্ত ছিলেন। কারণ আমাদের শুটিংয়ে অনেক সময় লেগেছিল। কিছুদিন আগেও একটি অনুষ্ঠানে সাদি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, সেই চিরাচরিত মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেছিলেন ‘কেমন আছিস রে’। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকম বিনয়ী গুণী ও অমায়িক মানুষ বিরল। সাদি ভাই যেখানেই থাকো ভালো থেকো।
সাদি মহম্মদের মৃত্যুর খবর পাই সন্ধ্যার পর। বিশ্বাস হচ্ছিল না। দীর্ঘদিনের পরিচিত সে। সেই মানুষটির মধ্যে আর প্রাণ নেই এটা মেনে নিতেই কষ্ট হচ্ছিল। তাই ছুটে যাই তার বাসায়। রবীন্দ্রসংগীতের কত বড় মাপের সংগীতশিল্পী তিনি ছিলেন, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। বাংলাদেশের কালজয়ী এই গায়কের মৃত্যু আমাদের সংগীতাঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
আমি মিউজিক কলেজে তার সরাসরি ছাত্রী ছিলাম। মাঝেমধ্যেই তার বাসায় গান শিখতে যেতাম। আমার খুব প্রিয় শিক্ষক তিনি। সব শিল্পীকে সহশিল্পী ভাবতেন। রবীন্দ্রসংগীতের কত বড় মাপের শিল্পী তিনি ছিলেন, তা সবাই জানেন। অথচ একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক কিছুই তিনি পাননি। বুকভরা অভিমান নিয়েই তিনি চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটা মানুষ গানের চর্চায় নিজেকে উৎসর্গ করে রেখেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তানপুরা নিয়ে বসেছিলেন। সুরের চর্চা আর সাধনার মধ্য দিয়েই জীবনকে সাঙ্গ করছেন তিনি। উপরে ভালো থাকুন।