বিদেশি কর্মীদের কাছ থেকে কর আদায়ে এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) সব উদ্যোগই ব্যর্থ। বিমানবন্দরে আয়কর বুথ স্থাপন, বিদেশি নাগরিক কাজ করেন এমন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে টাস্কফোর্স গঠন এবং তথ্যভান্ডারের পরিকল্পনা এখন শুধুই খাতাকলমে বন্দি। বিদেশিরা প্রকৃত বেতনভাতা গোপন করে ওয়ার্ক পারমিট নেওয়ায় সরকার আয়কর হারাচ্ছে। অন্যদিকে হুন্ডিতে বাকি টাকা পরিশোধ করায় দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বৈধভাবে কাজ করতে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমতি নিতে হয়। এছাড়াও এনজিও ব্যুরো ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) বিদেশিদের কাজের অনুমতি দিয়ে থাকে। বিদেশিদের হয়ে তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অনুমতি নিয়ে থাকে।
ইমিগ্রেশন পুলিশের ডেটাবেজের তথ্যমতে, গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ২ লাখ ১২ হাজার ৬৭ জন বিদেশি অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৮৯ জনের। টুরিস্ট ক্যাটাগরিতে বেশি এসেছেন ভারতের নাগরিকরা, আর বিজনেস ক্যাটাগরিতে চীনের নাগরিক। দেশভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৬৮ হাজার ৩০৫ জন ভারতীয় নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তারা দেশে অবস্থান করছেন। এর পরের অবস্থানে আছেন চীনের নাগরিকরা। ভিসার শ্রেণি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অন অ্যারাইভাল ভিসায় বাংলাদেশে বেশি বিদেশি নাগরিক প্রবেশ করেছে। পুলিশের বিশেষ ব্রাঞ্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিদেশিদের কর নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করতে হয় বিধায় প্রকৃত বেতন আড়ালের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ কম বেতন প্রদর্শন করে বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট নেওয়া হয়ে থাকে। আফ্রিকানরা খেলোয়াড় কোটায় এসে পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে গার্মেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। সরকারি প্রকল্পে এ তিন শ্রেণির ভিসা নিয়ে অনেকে বেসরকারি কাজও করছেন। এতে সরকার সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা বঞ্চিত হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে বিদেশিদের কর ফাঁকি রোধে গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
অন্যদিকে এনবিআরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১ লাখ ৪ হাজার ৫৬৫ জন বিদেশি করদাতা হিসাবে নিবন্ধিত আছেন। তারা করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত আছে কর অঞ্চল-১১তে, ৩৭ হাজার ৬৭৭ জন। এর পরের অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-২। সব বিদেশির কর অঞ্চল-১১তে নিবন্ধন নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের অধিক্ষেত্র অনুযায়ী নিবন্ধিত হওয়ায় ঠিক কত বিদেশি করদাতা নিয়মিত রিটার্ন জমা দেন, সে তথ্য এনবিআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। এছাড়াও বাংলাদেশে ৭৯২টি বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস এবং ৩৬৫টি ব্রাঞ্চ অফিস এনবিআরের আওতায় নিবন্ধিত আছে।
২০১৬ সালে এনবিআরে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিদেশিদের কাছ থেকে কর আদায়ে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই টাস্কফোর্সে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), পুলিশের বিশেষ ব্রাঞ্চ (এসবি), ডিজিএফআই, এনএসআই, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেপজা, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, এনজিও ব্যুরো ও এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে কাজের সুবিধার্থে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলভিত্তিক টাস্কফোর্সকে ভাগ করা হয়। এ টাস্কফোর্সের কাজ ছিল প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে কর ফাঁকিবাজ বিদেশিদের চিহ্নিত এবং কর্মরত বিদেশিদের ডেটাবেজ তৈরি করা। শুরুর দিকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান হলেও পরে ঝিমিয়ে পড়ে। এখন কার্যক্রম বন্ধ আছে।
ওই টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও একটি স্থলবন্দরে আয়কর বুথ চালু করা হয়। ঢাকার হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত, সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরে আয়কর বুথে সহকারী কর কমিশনার পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগের আগে বিদেশিদের আয়কর প্রত্যয়নপত্র দেখানোর নিয়ম চালু করা হয়। এখন সেই বুথগুলোও বন্ধ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি কর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশে অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে। কোনো সংস্থা কাজের অনুমতি দেয়, আবার কোনো সংস্থা কর্মীদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। সব সংস্থার সমন্বয়ে ডেটাবেজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্ত ডেটাবেজ তৈরির কাজ এগোয়নি। তিনি আরও বলেন, বিমানবন্দরে আয়কর বুথ থাকার কথা। সেগুলো কী অবস্থায় আছে, তা জেনে জানাতে হবে। আর টাস্কফোর্সের কার্যক্রম বন্ধ আছে।
জানা যায়, অধিকাংশ বিদেশি কর্মী বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে টুরিস্ট ভিসা ব্যবহার করেন। এরপর বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। এনজিও, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রকৌশল, চিকিৎসা, গার্মেন্ট, মার্চেন্ডাইজিং, পরামর্শকসহ নানা পেশায় তারা কাজ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশিদের বেতনভাতা গোপন রাখা হচ্ছে। কারণ বিদেশিদের আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ আয়কর ধার্য আছে। মূলত কর ফাঁকি দিতেই এ কৌশল অবলম্বন করছে দেশীয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি গোপন চুক্তি অনুযায়ী বেতনভাতা পরিশোধ করতে মানি লন্ডারিংয়ের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা পাচার হচ্ছে।
বেতনভাতা কম দেখানোর মাধ্যমে বিদেশিদের কর ফাঁকি নিয়ে বিডার ৩৩৭তম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আলোচনা হয়। সভায় যেসব প্রতিষ্ঠানে বিদেশি কর্মী কর্মরত আছেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্টে ওয়ার্ক পারমিট অনুসারে বিদেশিদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে কি না, সে বিষয় অডিট রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট তৈরিতে হিসাববিদদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশকে (আইসিএবি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আইসিএবির সভাপতি মনিরুজ্জামান বলেন, অডিট রিপোর্টে বিদেশিদের বেতনভাতা আলাদা উল্লেখ করার সিদ্ধান্ত নিলে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্টরা সে অনুযায়ী রিপোর্ট করবে। বিডা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে হবে না, এ সিদ্ধান্ত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলকে (এফআরসি) দিতে হবে।
আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, অবৈধভাবে বিদেশীদের নিয়োগ দিলে জেল-জরিমানার বিধান আছে। কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিদেশিদের নিয়োগ দিলে নিয়োগদাতা হিসাবে ওই ব্যক্তিকে সর্বনিু তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।