বৃহস্পতিবার, ০২:২৪ পূর্বাহ্ন, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ঠা পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

উত্তরাঞ্চলজুড়ে তীব্র ঠান্ডা

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৭ বার পঠিত

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ক্রমাগত কমতে থাকা, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসায় রংপুরসহ এ অঞ্চলের ১৬ জেলায় এবার স্বাভাবিক সময়ের ১৫ দিন আগেই শুরু হয়েছে শীত। শুরু হয়েছে তীব্র ঠান্ডা।

গত তিন দিন থেকে কুয়াশার কারণে দিনভর সূর্যের দেখা মেলেনি এ অঞ্চলে। সন্ধ্যার পরই কুয়াশার চাদরে বন্দী হয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। শুরু হয়েছে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব।

এ অবস্থাকে ‘ডেঞ্জার’ উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চলমান আবহাওয়া পরিবর্তন না ঘটলে এবার শীতের তীব্রতা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এমন পরিস্থিতে এ অঞ্চলের পৌনে এক কোটি হতদরিদ্র মানুষের ভয়াবহ দুর্ভোগের দ্বারপ্রান্তে আছেন।

সূত্র জানায়, অগ্রহায়নের শুরু থেকেই এ অঞ্চলে ক্রমাগতই কাছাকাছি আসছে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। কমছে বাতসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও। এতে বাড়ছে আদ্রতার শতকরা হার। সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসা এবং সন্ধ্যায় বাতাসে আদ্রতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এবার ১৫ দিন আগেই এ অঞ্চলে শীত এসে গেছে। সাধারণত অগ্রহায়নের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুর দিকে এ অঞ্চলে শীত আসে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ওয়ারলেস অপারেটর মনজুর আলম জানান, গেল ১০ দিনে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ৫ থেকে ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠা-নামা করছে। এ সময়ের মধ্যে বাতাসের সর্বনিম্ন আদ্রতা ২২ শতাংশে নেমেছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, এবার অগ্রহায়নের প্রথম দিন থেকেই রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসা শুরু করেছে। ফলে শীত ও কুয়াশাও পড়া শুরু হয়েছে আগে থেকেই। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ক্রমাগত কমার কারণে প্রচন্ড শীত অনুভবের পাশাপাশি আগাম কুয়াশা পড়াও শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, আবহাওয়ার এ অবস্থার উন্নতি না হলে এবার তীব্রতর শীত পড়বে। এ মাস এবং আগামী মাসের মধ্যে চারটি তীব্র আকারের শৈত্য প্রবাহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন তাপমাত্রা তিন থেকে চার ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে আসতে পারে। যার পদধ্বনি ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শীতের তীব্রতা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করছেন এ আবহাওয়াবিদ।

সরেজমিনে পাওয়া তথ্য মতে, এবার এ অঞ্চলে অগ্রহায়নের শুরু থেকেই বাড়ছে শীতের তীব্রতা। মাগরিবের নামাজের আগেই বিস্তৃণ জনপদে দেখা যায় কুয়াশার চাদর। ফলে এ অঞ্চলের নগর বন্দর, পাড়া-মহল্লার আড্ডাস্থলগুলো এখন ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ শীতের গরম কাপড় পরে চলাফেরা শুরু করে দিয়েছেন। বাসা-বাড়িতে লেপ, কাঁথা বের করা হয়েছে। ভোরবেলাতেও কুয়াশার কারণে অনেক পরিবহন হেড লাইট জ্বালিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখছে। বুধবার থেকে সূর্যের দেখা পাচ্ছেন না এ অঞ্চলের মানুষ।

আগাম উদ্যোগ নেই : সরকারি হিসেবে এ অঞ্চলে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ। তাদেরকে সরকার ভিজিএফ ভিজিডিসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু এসব অতিদরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় কেনার তেমন একটা সামর্থ থাকে না। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার দেয়া শীতবস্ত্রই তাদের ভরসা।

অন্যদিকে সেন্টার ফর স্ট্যাটিসটিক্স অ্যান্ড ডেভলোপমেন্ট (সিএসডি) নামের একটি সংগঠন তাদের জরিপে বলেছে, উত্তরের ১৬ জেলায় সাড়ে আট হাজার বস্তিসহ প্রায় পৌনে এক কোটি অতিদরিদ্র মানুষের বসবাস। প্রতি বছরই শীতে তাদের অবস্থা কাহিল হয়। ভয়াবহ দুর্ভোগের মুখে পড়েন তারা। দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। প্রতি বছরই এ অঞ্চলে শীতের তীব্রতায় প্রাণহানির ঘটনা দেশে বিদেশের প্রেস, ইলেক্ট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজে স্থান পায়। এবার এ অবস্থা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বিষেশজ্ঞ পর্যায়ে বলা হলেও সরকারি ও বেসরকারিভাবে বুধবার পর্যন্ত আগাম কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসোর্স ইন্সটিটিউট-ইরি বাংলাদেশের কনসালটেন্টে ড. এমজি নিয়োগী নয়া দিগন্তকে জানান, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এবার দুই মাস আগেই শীত এসেছে উত্তরাঞ্চলে। অবস্থাদৃষ্টি মনে হচ্ছে, শীতের তীব্রতা বাড়বে বহুগুণ। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতেও পারে। এ অবস্থার স্থায়ী সমাধানে কোনো সরকারই কোনো আগাম উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। ফলে শীতের সময় জোড়াতালি দিয়ে সরকারিভাবে প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য সহযোগিতা করা হয়।

তিনি বলেন, এখনই শীত মৌসুমকে অগ্রাধিকার দিয়ে উত্তরাঞ্চলের জন্য সরকার পৃথক কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ না করলে এ পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহবুব জানান, ‘এবার এ অঞ্চলে আগাম শীত নেমেছে। কিন্তু সরকারি তরফে শীত প্রচন্ডভাবে আঘাত হানার পর উদ্যোগ নেয়া হয়, তাও প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। ফলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয় অতিদরিদ্র পরিবারগুলোতে। প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটে। এজন্য তিনি সরকারকে এখনই শীত মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছেন।

উত্তরাঞ্চলের ডিসি অফিস সূত্রগুলো জানায়, এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলের ডিসি অফিসগুলো থেকে শীত মোকাবেলায় শীতবস্ত্র এবং নগদ অর্থের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

জেলাগুলোর ত্রাণ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর শীতের মৌসুমে এ অঞ্চলে সরকারিভাবে কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৭২ হাজার। কিন্তু তা দিয়ে শীত মোকাবেলা করতে না পারায় ডেপুটি কমিশনাররা প্রতি জেলায় ৩০ হাজার করে মোট সাড়ে চার লাখ ৮০ হাজার শীতবস্ত্রের চাহিদা দিয়ে দফায় দফায় ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে।

রংপুরের জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন নয়া দিগন্তকে জানান, ‘চলতি শীত মৌসুমে এখন পর্যন্ত সরকার কোনো বরাদ্দ এখনো আসেনি। আমরা এরই মধ্যে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। তবে পীরগাছা এবং পীরগঞ্জে এরই মধ্যে সরকারি তরফে কিছু শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, আমরা এরই মধ্যে মিটিং করে জেলা থেকে শীতবস্ত্রের চাহিদা উপরে পাঠিয়েছি। খুব শিগগিরই এসব শীতবস্ত্র চলে আসবে। এছাড়াও নগদ অর্থের জন্য আমরা চাহিদা দিয়েছি। যাতে আপদকালীন সময়ে আমরা সেটা দিয়ে স্থানীয়ভাবে শীতবস্ত্র কিনতে পারি।

তিনি জানান, শীতে যেন এ অঞ্চলের মানুষ কোনো কষ্ট না পায় সেজন্য সকল উদ্যোগ নেয়া আছে। তিনি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারির পক্ষ থেকে শীতে দুঃস্থদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দাবি জানান।

শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব : রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল ও উত্তরাঞ্চলের জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে প্রকাশ, আগাম শীত আসায় এসব হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল ছাড়াও জেলা ও উপজেলা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারি ক্লিনিক এবং লোকালয়ের হাতুড়ে ও পল্লী চিকিৎসকদের চেম্বারেও রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্তদের ৭০ ভাগই নিউমোনিয়া, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং মাথা ব্যথার রোগী। এদের মধ্যে আবার ৮০ ভাগই বৃদ্ধ ও শিশু।

বার্ন ইউনিট : এই অঞ্চলে এশটি মাত্র বার্ন ইফনিট রয়েছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে মাত্র ১৪টি আসন আছে। এ অঞ্চলে শীত এলেই আগুন পোহানো রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সে কারণে বেড বাড়ানোর দাবি দীর্ঘ দিনের।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. এম এ হামিদ পলাশ জানান, এখন যে অবস্থায় আছে তাতে চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন পরিচালক নাই তাই পরিচালকের যে সুযোগ সুবিধা বা বরাদ্দ সেগুলো পাচ্ছি না। তারপরও চেষ্টা করছি যেভাবে রোগীদের সেবা দেয়া যায়। এখানে প্লাস্টিক ও বার্ন বিশেষজ্ঞ অপ্রতুল। দুইজন সহযোগী অধ্যাপকের বাইরে আর কোনো বিশেষজ্ঞ এখানে নাই। ফলে একদিকে অনেক বেশি রোগীর সংখ্যা, অনেক বেশি রোগীর চাপ, পাশাপাশি বেডের স্বল্পতা এবং দক্ষ লোকবলের অভাব। যখন একসাথে অনেক রোগী আসে তখন আমরা হিমশিম খাই। ফলে গুরুতর বার্ন যেটা আমরা চিকিৎসা দিতে পারি না ঢাকায় রেফার্ড করি।

তিনি আরো বলেন, ঢাকায় রোগী পাঠানোর দুটি সমস্যা একটি হলো ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। বিশেষ করে পোড়া যাওয়া রোগীদের প্রথম ছয় ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসা করাতে হয়। সে ক্ষেত্রে ঢাকায় পাঠাতে গেলে ১২ ঘণ্টা লাগে তাই রোগীর দ্রুত সুস্থ হওয়া কঠিন হয়।

ডা. পলাশ আরো বলেন, হাসপাতালের লোকবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদির চাহিদা দিয়ে বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছি শুধু আশ্বাস দিয়েছে বাস্তবে কোনো রূপ দেখতে পারিনি। বার্ন নিয়ে আলোচনা শুধু শীতকালেই হয়। এই সচেতনতা কার্যক্রম সারা বছরই হওয়া উচিত। তিনি শিশু, নারী এবং বৃদ্ধদের শীত থেকে বাঁচতে আগুন না পোহানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়াও তাদের দেরিতে বিছানা ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

কৃষিতে বিরূপ প্রভাব : এ সময়ে আলুর পূর্ণ মৌসুম। তাপমাত্রা ক্রমাগত নিচে নামায় আলু চাষিরা হতাশায় ভুগছেন। অন্যদিকে ধানের বীজতলা এবং শাকসবজিও বেশি শীতে সেভাবে বেড়ে উঠে না। এ অবস্থায় কৃষি বিভাগেরও সেভাবে দেখা পান না কৃষকরা। তারা নিজেদের বুদ্ধি এবং মাঠে থাকা ওষুধ এবং বীজ কোম্পানিগুলোর পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল।

রংপুর কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, বেশি শীত শুরু হওয়ায় আমরা এরই মধ্যে মাঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। বেশি শীত হলে বীজতলা, আলুর পাতাসহ শাকসবজির পাতা থেকে শীত নামিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও শীতজনিত রোগবালাই মোকাবেলায় ভালো কীটনাশক দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com