পশ্চিমা দুনিয়া অন্য মানবসমাজ থেকে স্বতন্ত্র কোথায়? তার স্বাতন্ত্র্য শুধু ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক নয়, কিংবা নয় কেবল বস্তু ও প্রযুক্তিগত বিচারে, বরং তা বৌদ্ধিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিচারেও। পশ্চিমের বৌদ্ধিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার প্রতিফলিত রূপ দেখা যায় ‘আমরা’ ও ‘তারা’র বিভাজনে। আমরা বলতে যারা ও যা কিছু পশ্চিমা, তারা বলতে যারা ও যা কিছু অপশ্চিমা। ‘আমরা’ হাজির হয়, যা কিছু ভালো, তা নিয়ে। ‘তারা’ হাজির হয় বিপরীতভাবে।
এই যে আমরা ও তারা, এর সবচেয়ে প্রকট প্রকাশ ঘটে ইসলাম প্রশ্নে। ইসলাম প্রশ্ন পশ্চিমের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতা।
এর কারণ ধর্ম, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও আচরণের ক্ষেত্রে মুসলমানরা তাদের থেকে ভিন্ন; অন্য দিকে উভয়ের মধ্যে হাজার বছর ধরে বয়ে গেছে দ্বন্দ্বের স্রোত।
ইসলামোফোবিয়া জন্ম নিয়েছে সেই শত্রুতার গর্ভ থেকে। ইসলাম প্রশ্নে পশ্চিমের মনে যে ঘৃণা, ভয় ও জিঘাংসা, তারই রক্তজল থেকে এর বিকাশ ও বিস্তার। ইসলামোফোবিয়া ইসলাম ধর্ম বা সাধারণভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভীতির চর্চা করে, ঘৃণা ও কুসংস্কার ছড়ায়। বিশেষভাবে এটি করে মুসলিমদের একটি ভূ-রাজনৈতিক শক্তি বা সন্ত্রাসবাদের উৎস হিসেবে দেখানোর মধ্য দিয়ে। বহুকাল ধরে পশ্চিমা মনে ইসলামপ্রশ্ন যে একান্ত লালিত গোপন রোগের আকারে ক্রিয়াশীল, সে ধারাবাহিকতায় সমসাময়িক ইসলামোফোবিয়া হলো জৈবিক বা সাংস্কৃতিক বর্ণবাদের সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ তৈরির এক প্রকরণ।
আজকের দুনিয়ায় জ্ঞানক্ষেত্রে ‘ইসলামোফোবিয়া’ বহুল উচ্চারিত। তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক এই শব্দটি পাশ্চাত্যের সাথে ইসলামের বিশেষ সম্পর্ককে বোঝায়। শব্দটি সাইকোপ্যাথলজি থেকে আংশিকভাবে ধার করা, যা ইসলামের ব্যাপারে রুগ্ণ ‘ভয়’ বা ‘বিদ্বেষে’র প্রতিনিধিত্ব করে। এর অতীত ইতিহাসের পুরনো অধ্যায় বটে, কিন্তু এর ধারাবাহিকতা কখনো থামেনি বরং প্রবলভাবে জীবন্ত।
পাশ্চাত্য ও ইসলামের মধ্যে অশান্ত সম্পর্কের দীর্ঘ এক পরিক্রমার ফলে পশ্চিমা মানসিকতায় ইসলামোফোবিয়া একটি স্থির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যা দাবি করে, ইসলাম হলো পাশ্চাত্যজাত সবকিছুরই প্রতিপক্ষ।
সমকালীন সময়ে ইসলামোফোবিয়াকে তাত্তি¡ক পাহারা দেয়ার কাজে প্রধান প্রভাবক আমেরিকান লেখক স্যামুয়েল হান্টিংটনের ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থটি, যা আমেরিকার চেয়ে ইউরোপে প্রভাব ফেলছে অনেক বেশি। ইসলাম এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের ঘটনা জড়িয়ে পড়ার ফলে ইউরোপ যে ভয় ও আতঙ্কের সম্মুখীন হচ্ছে, তাতে প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছেন মুসলিম অভিবাসীরা। বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই একুশ শতককে পাশ্চাত্য ও ইসলামের ব্যাপক সাংস্কৃতিক সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র বলে মনে করেন। নাইন-ইলেভেনের ঘটনা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধিতে গভীর প্রভাব ফেলে; বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মুসলমানরা সন্দেহ, হয়রানি এবং বৈষম্যের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন। ইসলামোফেবিয়ার বুদ্ধিজীবিতা দাবি করে, ইসলামই এ পরিস্থিতির জন্য একমাত্র দায়ী।
ইসলামোফোবিয়াকে যদি আমরা তার উদ্ভব, ক্রমবিকাশ ও আজ অবধি এগিয়ে আসার ধাপগুলোসহ বুঝতে চাই, তাহলে তার পথপরিক্রমাকে কয়েকটি ধাপে প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন-
এক. রাসূল সা:-এর যুগ থেকে ইসলামের বিস্তৃতি শুরু। পরবর্তী কয়েক শতকে মুসলমানরা রোমানদের পরাজিত করে, তাদের বিশাল সাম্রাজ্য ধ্বংস করে। ১৬ হিজরিতে (৬৩৬ খ্রি.) ইয়ারমুক যুদ্ধে রোমকদের পরাজয় ছিল এক সিদ্ধান্তমূলক ঘটনা। এর ফলে রোমানরা আরব অঞ্চলে কর্তৃত্ব হারায়। এ ধারায় পরবর্তী রোমান উত্তরসূরিদের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ভয় ও বিদ্বেষ তৈরি হয়। সে বিদ্বেষের আগুন আরো প্রজ্বলিত হয়, যখন মুসলমানরা স্বয়ং পশ্চিমের ভূমিতে বিজয়ী হয়ে প্রবেশ করেন এবং শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা ঘটে দ্রুতই। ৯১ হিজরি/ ৭১১ খ্রি. এ স্পেন বিজয়, ১১৪ হিজরি/ ৭৩২ খ্রি. এ টুর্সের যুদ্ধ, ২১২ হিজরি/৮২৭ খ্রি. এ সিসিলি -পালের্মো বিজয়, ৮৫৭ হিজরি/ ১৪৫৩ খ্রি. এ ওসমানীদের হাতে কনস্টান্টিনোপল বিজয়- ইত্যাদি পশ্চিমা দুনিয়াকে বহুমাত্রিক আশীর্বাদে ঋদ্ধ করলেও এর ফলে খ্রিষ্টীয় অভিঘাত ছিল ভয়াবহ।
মুসলিম সংস্কৃতির উত্থান ও দ্রুত সম্প্রসারণ এবং ইসলামী সভ্যতার বিকাশকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক-উভয় দিক থেকেই বিপদ হিসেবে দেখে পশ্চিমা বিশ্ব। ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মের মাঝে ধর্মতাত্ত্বিক মিল (আসমানী ধর্ম) থাকার কারণে উভয়ের সম্পর্কে মেরুকরণ তৈরি হয়। মুসলিমদের মতো খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরাও বিশ্বাস করতে থাকে যে, তাদের ধর্ম শেষ ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
খ্রিষ্টানরা নিজেদের ধর্মকে প্রাধান্য দেয়, ইসলামকে করতে থাকে হেয়। ইসলামে ঈসা মসিহ ও হজরত মরিয়ম আ. পরম শ্রদ্ধায় বরিত হলেও খ্রিষ্টান দুনিয়ায় মহানবীর সা: প্রতি নিন্দা ও অপমানের ঝড় বইতে থাকে। গির্জার মতে, ইসলাম হলো ধর্মচ্যুতির নমুনা। এ ধর্মের প্রচার করে গেছেন এক ‘বিভ্রান্ত’ নবী; তার আদর্শ খ্রিষ্টবাদের নকল, খ্রিষ্টবাদের জন্য হুমকি।
ইতালীয়-আমেরিকান বুদ্ধিজীবী জন এসপোসিতো (জন্ম : ১৯৪০-) দেখান, ‘এর ফলে ভয় ও অজ্ঞতা তাদের মাঝে এমন পৌরাণিক ভাবনা তৈরি করে, যা নিতান্তই অমূলক ও নিরর্থক : মুসলমানরা মূর্তি পূজা করে, মিথ্যা ট্রিনিটির উপাসনা করে। মুহাম্মদ একজন জাদুকর; তিনি রোমের চার্চের অন্যতম প্রধান। পোপ হওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষা ব্যর্থ হলে বিদ্রোহ করেন এবং আরবে পালিয়ে যান। সেখানে নিজের জন্য একটি ব্যক্তিগত চার্চ প্রতিষ্ঠা করে।’ যার ফসল হলো ইসলাম!
দুই. একাদশ শতাব্দীজুড়ে ইউরোপ নতুন যুগের সম্ভাবনার দিকে পথ পাড়ি দিচ্ছিল। যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ক্রুসেড। তখন ক্রুসেডীয় ভাবনার অন্যতম কেন্দ্রে ছিল প্রথম সহস্রাব্দের শেষে বিশ্বের সমাপ্তি। গির্জা প্রচার করছিল দুঃখের অবসানের পন্থা। সেখানে পরিত্রাণের জন্য জেরুসালেমে তীর্থযাত্রা ছিল একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। আসলেই তখন পশ্চিম ইউরোপের ক্যাথলিকদের মাঝে জেরুসালেমে তীর্থযাত্রার হার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তা ক্যাথলিক প্রোপাগান্ডার এমন এক প্যাটার্ন তৈরি করে, যা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের হিস্টিরিয়াজাত আবেগমত্ততার মোহনায় মিলিত হয়। তারা চায় খ্রিষ্টের জন্মভূমি ও সমাধিভূমি মুসলমানদের হাতে না থাকুক। ক্যাথলিক গির্জা এ ক্রান্তিলগ্নে নিজেকে ত্রাণকর্তা মনে করে। তারা মুসলিম ‘বর্বর’দের হাত থেকে জেরুসালেমের ‘মুক্তির’ প্রতিনিধিত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়। তখন ইউরোপীয় মানসিকতা মুসলমানদের প্রতি তাদের স্বাভাবিক শত্রুতার গণ্ডি পেরিয়ে হিস্টিরিয়াজাত উন্মত্ত বিদ্বেষে ফেনায়িত হয়।
ফলে প্রথম ক্রুসেড আক্রমণে খ্রিষ্টানদের যে সাড়া, তার সুস্পষ্ট কারণ আমরা নির্ধারণ করতে পারি। এতে শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্বেষই ছিল না, বরং ছিল প্রোপাগান্ডা ও ভুল বুঝাবুঝি; ছিল ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে অলীক ও পৌরাণিক কাহিনীর প্রসার। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে নিয়ে ক্রুসেড যেসব প্রপাগান্ডা ছড়াতো, তার কেন্দ্রে ছিল কয়েকটা গালি। যেমন ‘চরমপন্থী’, ‘সন্ত্রাসী’ ‘ভণ্ডনবী ও ‘নারীকামুক’ ইত্যাদি। এসব গালি জন্ম নেয় ক্রুসেড যুগের পৌরাণিক কল্পকাহিনীর গর্ভ থেকে। আজ যখন ক্রুসেড আবারো মাথা তুলতে চায়, তখন সেসব গল্প ও গালি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। ইসলামোফেবিয়া এগুলোকে নবজীবন দিচ্ছে, বৈশ্বিক বিস্তার দিচ্ছে। অতীতের ক্রুসেডের মতো আজও ইসলামোফোবিয়ার মূল ভিত্তি প্রোপাগান্ডা, মুসলিমের চরিত্র হত্যা ও বিভিন্ন মিথ্যার জোড়াতালি।
তিন. ১৯৮৯ সালে হাজির হয় একটি অনাকাক্সিক্ষত প্রেক্ষাপট। তখন জার্মানির বার্লিন প্রাচীরের পতন হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে সালমান রুশদিকে নিয়ে দেখা দিয়েছে অস্থিতিশীলতা, একই সময়ে ফ্রান্সে শুরু হয় হিজাব বিতর্ক। তখন বেশ কয়েকটি ঘটনায় ইউরোপীয় মুসলিম সংখ্যালঘুরা চলে আসছে হিংসাদৃষ্টির কেন্দ্রে। তাদের বিশ্বাস ও স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে চলতে থাকে চর্চা। ডেমোগ্রাফিতে মুসলমানদের হার বৃদ্ধির কারণে বিষয়টিকে ‘অভিবাসন-সঙ্কট’ হিসেবে দেখানো হয়নি শুধু, বরং সেখানেও হাজির করা হয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।
সমগ্র ইউরোপে মুসলমানদের সংখ্যা ২৩ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ। এর সাথে যদি তুরস্কের মুসলমানদের যোগ করা তবে সে হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ। বিষয়টিকে ডানপন্থী-উগ্রবাদীরা ‘ইউরোপের ইসলামীকরণ’ হিসেবে অভিহিত করে। ফলে অনেকের মাঝে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ অনেকটা ন্যায্যতা পায়।
চার. ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা চিন্তকদের বিকৃত প্রচারের অন্ধ অনুবর্তন ইসলামোফোবিয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। সেসব চিন্তকের মাঝে আছেন অত্যন্ত প্রভাবশালী দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী। যেমন, আধুনিক বিশ্বে চিন্তক হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮)। তিনি একটি বই লেখেন, Le fanatisme, ou Mahomet le Prophète নামে, শুদ্ধ বাংলায়, ‘সহিংসতা বা নবী মোহাম্মাদ!’ আর্নেস্ট রেনান (১৮২৩-১৮৯২) জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রগতিকে ইসলামের সাথে সমন্বয়হীন বলে সাব্যস্ত করেন। ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন একাডেমিক মহলে চলছে এ ধরনের বিকৃতি, বিদ্বেষ বা অজ্ঞতার চর্চা। ফলে এমন প্রজন্ম তৈরি হতে থাকে, ইসলাম সম্পর্কে যাদের জানার শুরু ও শেষ হলো- এটি প্রতিক্রিয়াশীলতা, নারীবৈরিতা, বর্বরতা ও সন্ত্রাসবাদ!
পাঁচ. ইসলাম সম্পর্কে ইউরোপের যে ভীতি, তার মূলে হয় অজ্ঞতা আছে, নয় আছে বর্ণবাদী মন। কারণ ইসলামের যে চেহারা তারা তুলে ধরেন, তা প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী। এ ধারা আজও কেন চলমান? পাশ্চাত্যের নেতৃত্বে বিশ্ব এখন বিশ্বায়নের মধ্যদুপুরে। জাতিসমূহকে জানা, পারস্পরিক আদান-প্রদান, সভ্যতা-সংস্কৃতির বিনিময়, পুরনো অজ্ঞতা অতিক্রম করে জ্ঞানালোকের ভিত্তিতে সহাবস্থান বিশ্বায়নের দাবি। শুধু ইসলামের প্রশ্নে সেটা হবে না কেন?
উল্টো বরং পশ্চিমা দুনিয়ায় বসবাসরত মুসলিম কমিউনিটি বিভিন্ন সঙ্কটের মুখে পড়ছে। ফ্রান্সে হিজাব-বুরকিনি বিতর্ক, সুইজারল্যান্ডে মিনার নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা, ডেনমার্কে নবীর ব্যঙ্গচিত্র, ব্রিটেন-কানাডায় মসজিদে আক্রমণ, আমেরিকায় পদ্ধতিগত মুসলিম বিতাড়ন ইত্যাদির মধ্যে সেই সঙ্কটের স্বরূপ স্পষ্ট। তার পরও অনেক চিন্তক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন, যারা ইসলাম নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন এবং সঠিক উপলব্ধি তাদেরকে ইসলামে নিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে আছেন মরক্কোর জার্মান রাষ্ট্রদূত মুরাদ হফম্যান (১৯৩১-২০২০), প্রসিদ্ধ ফরাসি চিন্তক রজার গারুদি (১৯৩৩-২০১২), টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা লরেন বুথসহ (১৯৬৭- ) অনেকেই।
পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার চিত্র ধরা পড়ে নাইন-ইলেভেনের পর কুরআন অধিক ক্রয়কৃত গ্রন্থের তালিকায় উঠে আসার প্রেক্ষাপটে। কারণ, লোকেরা মনে করত কুরআনে এ আক্রমণের কারণ ও প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যাবে।
ছয়. প্রাচ্যবাদ ও ইসলাম বিকৃতি এ ফোবিয়ার জমি তৈরিতে বিশেষভাবে কাজ করে। বিপুল সংখ্যক প্রাচ্যবিদ ইসলাম ও মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেন। কখনো ইচ্ছেকৃতভাবে তারা নিজেদের উপস্থাপিত তথ্যের আলোকে উপসংহার সাজায়, কখনো ঐতিহাসিক বিকৃতির মাধ্যমে মুসলমানদের অতীতকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। মুসলিম সংস্কৃতির হীন ও হেয় চিত্রায়নে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াস চালায়। ইসলামের অকাট্য ও মৌলিক বিষয়গুলোতে সন্দেহ উত্থাপন করে এবং তার যথাযথ অবস্থান ক্ষুণ্ণ করতে চায়।
সাত. বার্নার্ড লুইস (১৯১৬-২০১৮) ও ‘ইসলামী ঝুঁকি’র সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ। ইহুদি বংশোদ্ভূত এ চিন্তাবিদ পাশ্চাত্যকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে স্যামুয়েল হান্টিংটনের পথিকৃৎ। তিনি মিথ্যা ‘ইসলামী ঝুঁকি’ ও ‘ইউরোবিয়া’ (ইউরোপের আরবিকরণ) নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচার চালান। জোরেশোরে এক কল্পিত সম্ভাবনাকে রাষ্ট্র করেন যে, একুশ শতাব্দীর শেষে ইউরোপ হয়ে উঠবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। বার্নার্ড লুইস জনপ্রিয় হন। তার জনপ্রিয়তার পেছনে ছিল দুই কারণ।
১. তিনি ইতিহাসকে আংশিকভাবে নিজের অনুমান ও যুক্তির অনুক‚লে ব্যবহারে অনেকটা পারঙ্গম।
২. ইসলামী অনুপ্রবেশের ভয় ছড়ানো এবং মুসলমানদের ইউরোপ থেকে বিতাড়িত করার ব্যাপারে সব মহলের কাছে তার প্রস্তাবনা।
আট. মুসলিমদের নানা প্রান্তিকতা, আচরণের সমস্যা, স্থানীয় সংস্কৃতির চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলামকে বোঝা ও বোঝানোর চেষ্টা পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলাম হিসেবে এমন কিছুকে উপস্থাপন করে, যা ইসলাম নয়। পাকিস্তান-জর্দান-লেবানন ইত্যাদির বিভিন্ন গোত্রে অনার কিলিং বা সম্মান রক্ষার জন্য হত্যার কুসংস্কার রয়েছে। নারীরাই হয় এর প্রধান শিকার। এ জন্য দায়ী করা হয় ইসলামকে। ইসলামের সাথে যার কোনো যোগসূত্র নেই। ভারতে হিন্দু সমাজে, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশে খ্রিষ্টান সমাজে এর চল এখনো নিঃশেষিত হয়নি।
নয়. ইসলামকে প্রধানত সেভাবেই দেখা হচ্ছে, মিডিয়া যেভাবে দেখাচ্ছে। এর ফলে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার চেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ইসলাম সম্পর্কে ভুল জানা।
পলিটিকস ফার্স্ট ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক মারকাস পাপাদোপুলাসের মত হচ্ছে, ব্রিটেন এবং পশ্চিমা দেশে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। প্রেস টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ব্রিটেনের লোকজন ইসলামের বিষয়গুলো নিয়ে দ্বিধান্বিত। কারণ তারা ইসলামকে সঠিকভাবে জানে না। মনে করে ইরাক ও সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তারকারী ইসলামিক স্টেট যা কিছু বলে, সেটাই ইসলামের সত্য। ফলে সভ্যতা, মানবতা ও শান্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা একে ভাবতে শেখে।
দশ. বর্তমান যুগে বিশ্বজুড়ে ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধির অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট নাইন-ইলেভেন। বরং তাকে সামগ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনের পেছনে দায়ী করা যায়। নাইন-ইলেভেন পরবর্তী পশ্চিমা রাজনীতির পর্যায়গুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ‘ইসলামী চরমপন্থা’ রোধের নামে উল্টো নিজেরাই চরমপন্থা অবলম্বন করছে। মুসলমানদের ওপর পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি চালিয়ে তাদের নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত করেছে, সেগুলোকে সংজ্ঞায়িত করেছে বিভিন্ন পরিভাষায়। তারা মুসলমানদের বিভাজিত করছে চরমপন্থী ও মধ্যমপন্থী হিসেবে। তারা যাতে পশ্চিমা ব্যবস্থার বিকল্পে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য প্রণয়ন করছে লিবারেল ইসলাম; সে জন্য ব্যয় করছে বিরাট অঙ্কের বাজেট।
হান্টিংটনের ভাষায় মুসলমানদের আছে আদর্শিক দৃঢ়তা, জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও সামরিক দক্ষতা। বিষয়টি যদি এরূপই হয়, তবে আমেরিকা এ শত্রæর মোকাবেলায় সবকিছুই করবে। তাতে নীতি-নৈতিকতা ও সত্য-মিথ্যার প্রভেদ থাকবে না। তাদের পদক্ষেপ হবে সামরিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক- সব ক্ষেত্রে। এখান থেকেই ইউরোপ ও আমেরিকার ইসলাম-বিরোধিতার নতুন যুগের সূত্রপাত।
দেখা যাচ্ছে, যে তীব্রতায় ইসলামোফোবিয়া বাড়ছে, তা সহসা-উদ্ভূত নয়, বরং এক ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ার কাঠামোর মধ্যে বেড়ে উঠেছে। বর্তমানে এর রয়েছে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক। এর সাথে প্রবলভাবে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি, সরকার, থিংকট্যাংক, ইনস্টিটিউট, মিডিয়া হাউজ, চলচ্চিত্র, এমনকি শিল্প-সাহিত্যের মতো ক্ষেত্র। যা সব পথ ধরে ইসলাম প্রশ্নে বিদ্বেষ ও বিনাশের মন তৈরি করছে।
এটি বোঝা এবং এর মোকাবেলা করা শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, বিশ্বশান্তির জন্য জরুরি।
লেখক : কবি, গবেষক