আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ‘আন্দোলন ও নির্বাচনী সমঝোতা’ গড়া চেষ্টা করছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামি দলগুলো। নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে স্বতন্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলা, নির্বাচনী সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দেওয়া এবং মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলাই তাদের এ সমঝোতা চেষ্টার প্রাথমিক উদ্দেশ্য। কিন্তু এসব দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্কের পিছুটান ছিন্ন করাই তাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি- উভয় বলয়ে ইসলামি দলগুলোর ‘চাহিদা’ আছে। আবার কোনো কোনো দলের সখ্যতা জামায়াতের সঙ্গে। এ অবস্থায় ‘আন্দোলন ও নির্বাচনী সমঝোতা’ হবে কিনা, তা নির্ভর করবে বিএনপির আন্দোলনের ওপর। রাজনীতির পাল্লা যেদিকে ভারী থাকবে, তাদের সিদ্ধান্তও সেদিকে যাবে।
নিরপেক্ষ সরকারের আন্দোলনে ইসলামি দলগুলোর কোনো ভূমিকা থাকবে কিনা, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আমরা কথা বলে আসছি। অবৈধ, অনৈতিক, অসামাজিক, অসাংবিধানিক- এসব বিষয়ের ওপর আমাদের আলোচনা আছে। সেই হিসেবে আমাদের আলোচনায় এসব বিষয় থাকবে। এক কথায় নির্দলীয়-নিরপেক্ষ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যে নির্র্বাচন হবে, তাকে আমরা সমর্থন করি। ইভিএমে ভোটগ্রহণকেও সমর্থন করেন না বলে জানান রেজাউল করীম। তিনি বলেন, যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে, তাদের সিংহভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিরুদ্ধে মত দিয়েছে।
মূলত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই নির্বাচনী সমঝোতার প্রয়াস চলছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামপন্থি দলের সংখ্যা ১০। এর মধ্যে পাঁচটি দল এক সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থাকলেও বিভিন্ন সময় তারা বের হয়ে গেছে। মূলত এই দলগুলোকে নিয়েই একটি নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টা হচ্ছে।
দলগুলো হচ্ছে- প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মুফতি আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, মুহাম্মদ ইসহাক ও আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস, শায়খ যিয়াউদ্দিন ও মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। এর বাইরে আছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূলত এই কয়টি দলের প্রভাব রয়েছে। এদের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত কয়টি দল একমত হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভেতরেই। এসব দলের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ আছে। অন্যদিকে নানা মহলের নানামুখী চাপ ও নজরদারিতে স্বস্তিতে নেই ধর্মভিত্তিক ইসলামি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো।
এর বাইরে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট (আবদুর রকিব) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (মনসুরুল হাসান) একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে। কিন্তু এই তিনটি দলের কোনোটির রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে।
অন্যদিকে নিবন্ধিত ইসলামপন্থি অন্য দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। এ ছাড়া ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (এমএ মতিন) এবং জাকের পার্টিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে। ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে ঐক্য গড়ার চেষ্টার সঙ্গে থাকা গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, যারা আওয়ামী লীগ জোটে বা তাদের ঘনিষ্ঠ, সেসব দলগুলোর পক্ষে অন্য কোনো জোটে বা নির্বাচনী সমঝোতায় যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু ইসলামি দল সর্তকতার সঙ্গে তাদের সঙ্গে ‘ভেতরে ভেতরে’ যোগাযোগ রাখছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বাইরে যেসব দল আছে, তারা শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। এসব দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সংলাপ হবে। হয়তো কোনো কোনো দল সরকারের চাপে প্রকাশ্যে আসতে পারছে না, তারাও সময়-সুযোগ হলে রাজপথে নামবে। আমরা সবার জন্য রাজপথে অপেক্ষায় থাকব।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, তারা কোনো রাজনৈতিক জোটে নেই। এ অবস্থায় সামনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী হয়, আমরা কোন পথে যাব- এসব বিবেচনায় নেওয়ার অবকাশ আছে। আবারও ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন হলে আমরা অংশ নেব কিনা, ভেবে দেখব। ফলে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হয় এবং নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে- তার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনী সমঝোতা হবে। এখন সব দল যার যার মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, আমরা রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টিও রাখছি। রাজনীতিতে শেষ কথা নেই। আমরা নির্বাচনে যাব কিনা, সেটি পরিস্থিতির আলোকে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সম্প্রতি রাজধানীর মহাখালীতে বিক্ষোভ শেষে সংক্ষিপ্ত পথসভায় জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বলতে চাই, আর সময়ক্ষেপণ করলে জনগণের অনাস্থা চলে আসবে। আপনারা ঘোষণা দেওয়ার সময় পাবেন না। যদি যুগপৎ আন্দোলন চান, অনতিবিলম্বে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করুন। আমরা জামায়াতে ইসলামী রাস্তায় চলে এসেছি। আমরা থাকব।’
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন থেকেই ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট প্রার্থী বাছাইও প্রায় শেষ করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। গত জুলাই মাসে দলটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
এদিকে ঐক্য গড়তে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তারা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা করছেন। জাতীয় পার্টির সঙ্গেও আলোচনা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জামায়াত ছেড়ে নতুন দল গঠন করা এবি পার্টির নেতারা। এ ছাড়া নতুন দল গণঅধিকার পরিষদ ও এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে, তার নির্ভর করবে রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ওপর।