কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হলের প্রভোস্ট শামসুল আলম, হাউজ টিউটর মৌমিতা আক্তার ও ইশরাত জাহানসহ কয়েকজনের দায়িত্বে চরম অবহেলা পেয়েছে আদালতের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি।
আর প্রক্টর শাহাদাত হোসেনের কর্মকাণ্ড উদাসীনতা ও দায়সারা গোছের বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এছাড়া ইবির দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ওই ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পৃথক তদন্ত কমিটি।
বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে মঙ্গলবার পৃথক দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তুলে ধরেন ডেপুটি অ্যাটর্নি তুষার কান্তি রায়।
প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর হাইকোর্ট বুধবার আদেশের জন্য দিন রেখেছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও আইনের অধীনে প্রণীত বিধি-প্রবিধানমালা সংগ্রহ করে তা দেখাতে এবং ইবির কোনো আইনজীবী থাকলে তাকে জানাতেও বলেছেন আদালত।
১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন ফিন্যান্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুন। এ ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি রিট করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও ইবির সাবেক শিক্ষার্থী গাজী মো. মহসীন।
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল দিয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন, নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ওই নির্যাতনে জড়িত বলে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও তাবাসসুম নামের যে দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে রাখাসহ কয়েক দফা নির্দেশ দেন।
তিন সদস্যের কমিটিতে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা, জেলা জজ মনোনীত বিচার বিভাগীয় একজন কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপককে রাখতে বলা হয়। কমিটি প্রতিবেদন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আদালতে জমা দিতে বলা হয়। ওই ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত কমিটির প্রতিবেদনও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার পৃথক প্রতিবেদন সিলগালা অবস্থায় আদালতে দাখিল করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। পরে আদালতে প্রতিবেদন দুটির অংশবিশেষে পড়ে শোনান তিনি। রিটের পক্ষে গাজী মো. মহসীন শুনানিতে ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী ফুলপরীকে র্যা গিং, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশদাতা এবং ওই পাশবিক, অমানবিক ও ন্যক্করজনক ঘটনা সংঘটনে হুকুমদাতা। ওই অমানবিক, পাশবিক ও ন্যক্করজনক জঘন্য ঘটনার সঙ্গে হালিমা আক্তার মুন্নী, ইশরাত জাহান মীম, তাবামসুম ইসলাম, ময়াবিয়া জাহান জড়িত এবং তাদের দ্বারা ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে। তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ফুলপরীকে পাশবিক কায়দায় অমানবিকভাবে নির্যাতন করে।
ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে। আর বলা হয়, সরাসরি নির্যাতন করে হালিমা আক্তার মুন্নী, ইশরাত জাহান মীম, তাবাসসুম ইসলাম ও ময়াবিয়া।
তাবাসুমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে প্রতীয়মান হয় যে, ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ডাইনিংয়ে ফুলপরীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের সময় উর্মি ও মীম ভিডিও ধারণ করে। তবে কোনো ভিডিও রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
এছাড়া গণরুমে উপস্থিত ছাত্রীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আল আমিন কর্তৃক ফুলপরীকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির ভাষ্য, তাবাসসুম ফুলপরীকে ৮ ফেব্রুয়ারি দেখা করতে বললে সে ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে দেখা করে- তাবাসসুম এটিকে বেয়াদবি হিসেবে মনে করে। এ কারণে তাবাসসুম ব্যক্তিগতভাবে ফুলপরীর ওপর রাগান্বিত হয়। এটিই তাবাসসুম প্রচার করে ফুলপরী সিনিয়রদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। এ থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয়।
তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, তাবাসুমের নেতৃত্বে ১০৫ নম্বর রুমে পিংকীর উপস্থিতিতে ফুলপরীকে ১১ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় অন্যান্য মেয়েদের উপস্থিতিতে গণরুমে হেনস্তা করা হয়। আজেবাজে কথা বলা হয়। পরবর্তীতে অন্তরার উপস্থিতিতে রাত নয়টার দিকে ৩০৬ রুমে (ফুলপরীর বক্তব্যে গণরুম) নিয়ে ফুলপরীকে মেয়েদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ গালিগালাজ এবং আজেবাজে কথা বলে মানসিক নির্যাতন করা হয়।
এমনকি সেই রাতে ৩০৬ নম্বর রুমে থাকা মেয়েদের অন্তরা নির্দেশ দেয় ফুলপরীকে প্রত্যেকে একটা একটা চড় মারতে। ফুলপরীর মোবাইল কেড়ে নেয় লিমা ও তাবাসসুম। নির্যাতনের একপর্যায়ে ফুলপরী অন্তরার পায়ে ধরতে বাধ্য হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফুলপরী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। অন্তরার নির্দেশে তাকে পাহারা দিয়ে রাখা হয়।
অন্তরার জোর-জবরদস্তির কারণে প্রভোস্ট ফুলপরীকে হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেন বলে তিন সদস্যের কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে।
বলা হয়েছে, এরপর প্রভোস্ট হলে উপস্থিত থাকা অবস্থাতেই অন্তরা, তাবাসসুম, মীম, উর্মি ও ময়াবিয়াসহ অন্যান্য মেয়েরা ফুলপরীকে হাত ধরে টানাটানি করে হেনস্তা করে। পরবর্তীতে ফুলপরীকে প্রভোস্ট শামসুল আলমের বরাবরে মুচলেকা দিতে বাধ্য হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি ফুলপরীর জবানবন্দি গ্রহণের সময় তার মুখের বামগালে কালো দাগ দেখা যায় বলে প্রতিবেদনে এসেছে। প্রতিবেদনের ভাষ্য, হলের প্রভোস্ট শামসুল আলম, সহকারী রেজিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, শাখার কর্মকর্তা হামিদা খাতুন, আয়া, ডাইনিং ম্যানেজার সোহেল রানা, হাউজ টিউটর মৌমিতা আক্তার ও সহকারী অধ্যাপক ইশরাত জাহানের দায়িত্বে চরম অবহেলা ও ফুলপরী ইস্যুতে গাফলতি ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া প্রক্টর শাহাদাত হোসেনের উদাসীনতা ও দায়সারা গোছের বলে প্রতিবেদনে এসেছে।