সোমবার, ১২:৪৫ পূর্বাহ্ন, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

ইউক্রেনে যুদ্ধে যাওয়া এড়াতে জঙ্গলে লুকিয়ে আছেন যে রুশ

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩
  • ৭৫ বার পঠিত

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রুশ সেনাবাহিনীতে আরো সেনা সমাবেশের এক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু এ্যাডাম কালিনিনের (আসল নাম নয়) কোনো ইচ্ছাই ছিল না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দেয়ার। এজন্য তিনি ভাবতে শুরু করেন কিভাবে এই ‘মোবিলাইজেশন’ এড়ানো যায়।

এ্যাডামের মনে হলো সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ ঠেকানোর সেরা উপায় হতে পারে একটাই। তা হলো জঙ্গলে গিয়ে থাকা।

তিনি ছিলেন একজন আইটি স্পেশালিস্ট বা তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। শুরু থেকেই তিনি ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। তিনি যে এ্যাপার্টমেন্ট ভবনে থাকতেন তার দেয়ালে তিনি ‘যুদ্ধকে না বলুন’ লেখা এক পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তাকে দু’সপ্তাহের জন্য জেল খাটতে হয়েছিল। এছাড়া দিতে হয়েছিল জরিমানাও।

সুতরাং রাশিয়া যখন ইউক্রেন যুদ্ধে আবার জয়ের ধারায় ফিরে আসার চেষ্টায় তিন লাখ সেনা নিয়োগের উদ্যোগ নিলো তখন কালিনিন আদৌ ইচ্ছুক ছিলেন না ইউক্রেনীয়দের হত্যার জন্য যুদ্ধে যোগ দেয়ার ঝুঁকি নিতে।

সেনাবাহিনীতে নিয়োগ এড়াতে ওই সময় লাখ লাখ রুশ দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। কিন্তু এ্যাডাম কালিনিন এমন কিছু করতে চাননি। তিনটি জিনিস তাকে রাশিয়ার সাথে বেধে রেখেছিল। বন্ধুবান্ধব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং পরিচিত জগৎ ছেড়ে যাওয়ার অনীহা।

কালিনিনের বয়স তিরিশের কোঠায়। বিবিসিকে তিনি বলেন, তার নিজস্ব যে ছোট জগতের ভেতর থাকতে তিনি আরাম বোধ করেন তা ছেড়ে যাওয়াটা ছিল তার জন্য খুবই কঠিন একটা পদক্ষেপ।

তার ভাষায়, ‘আমি যে এ জীবনেও খুব আরামে আছি তা নয়। কিন্তু তার পরও এটা ছেড়ে যাওয়াটা মানসিকভাবে খুবই কঠিন ছিল।’

তাই তিনি এমন এক পদক্ষেপ নিলেন যা সচরাচর কেউ করে না। তিনি তার স্ত্রীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন এক জঙ্গলে। সেখানে এক তাঁবু খাটিয়ে তিনি থাকছেন প্রায় চার মাস ধরে। সেই জঙ্গলে ইন্টারনেট পাওয়ার জন্য তিনি গাছের সাথে একটা এ্যান্টেনা বেঁধেছেন। বিদ্যুতের জন্য বসালেন সোলার প্যানেল। কিছুদিন পর পর তার স্ত্রী জঙ্গলে নিয়ে তার জন্য কিছু খাবার দিয়ে আসতেন।

সেই বনে তাকে সহ্য করতে হয়েছে প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়া। এক এক সময় তাপমাত্রা শূন্যের ১১ ডিগ্রি নিচে নেমে যেতো। কিন্তু তারপরও তার মনে হয়েছিল সেনাবাহিনীকে নিয়োগ ঠেকানোর জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে ভালো উপায়। কারণ আপনি যদি সব যোগাযোগের বাইরে থাকেন, কর্তৃপক্ষ যদি আপনার হাতে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ডাক পৌঁছে দিতে না পারে তাহলে আপনাকে কেউ যুদ্ধে যেতে বাধ্য করতে পারবে না।

তিনি বলেন, ‘ওরা যদি শারীরিকভাবে আমার হাত ধরে সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তির অফিসে নিয়ে যেতে না পারে তাহলে আপনি ৯৯ ভাগ নিরাপদ যে আপনাকে মোবিলাইজেশন বা অন্য কোনো রকম হয়রানি করা যাবে না’।

কোনো কোনো দিক থেকে কালিনিনের জীবন আগের মতই আছে। তিনি এখনো সেই একই চাকরি করেন। প্রতিদিন আট ঘণ্টা। তবে শীতের সময় দিন ছোট হয়ে যায় বলে আট ঘণ্টা কাজ করার মত সৌরবিদ্যুৎ পান না তিনি। ফলে শনি-রোববার কয়েক ঘণ্টা কাজ করে সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে দিতে হয়।

তার কিছু কিছু সহকর্মী এখন আছেন কাজাখস্তানে। সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তি শুরু হতেই তারা রাশিয়া ছেড়ে সেখানে চলে গিয়েছিলেন।

তবে একটা দূরপাল্লার এ্যান্টেনা পাইন গাছের গায়ে বেঁধে তিনি যে ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠা করেছেনতা যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য এবং যোগাযোগ তার জন্য তেমন কোনো সমস্যা নয়।

কালিনিন ‘আউটডোরের’ ভক্ত, বেড়াতে ভালোবাসেন তিনি। রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ক্যাম্পিং করে তিনি তার স্ত্রীর সাথে অনেক ছুটির দিন কাটিয়েছেন। জঙ্গলে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই তিনি এজন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন।

এই বনবাসী জীবনে তিনি যে টিকে থাকতে পেরেছেন তার এক বড় কারণ তার স্ত্রীর ভূমিকা। নতুন বছর শুরুর সময় কয়েক দিনের জন্য জঙ্গলের ভেতর কালিনিনের তাঁবুতে এসে থেকেছিলেন তার স্ত্রী। তিনি প্রতি তিন সপ্তাহে একবার করে খাবার এবং অন্যান্য সামগ্রী একটা বিশেষ জায়গায় নামিয়ে দিয়ে যান। সেই দিনটায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দু’জনের মুখোমুখি দেখা হয়।

এর পর কালিনিন তার খাবারগুলো আরেকটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যান। রান্নার জন্য তিনি একটি লাকড়ির চুলো বানিয়ে নিয়েছেন।

কালিনিন বলেণ, ‘আমার কাছে আছে ওট, ময়দা, চা, কফি, চিনি। ফল বা তাজা শাকসবজি বেশি নেই, কিন্তু তার পরও এটা খারাপ নয়।

রাশিয়াতে বরফের মধ্যে মাছ ধরার সময় যেসব বড় বড় তাঁবু ব্যবহার করা হয় সেরকম একটি তাঁবু দিয়েই জঙ্গলে নিজের ঘর বানিয়েছেন কালিনিন।

প্রথম দিকে জঙ্গলে আসার পর প্রথম দিকে তিনি দুটি তাঁবু বানিয়েছিলেন। একটি থেকে আরেকটিতে যেতে পাঁচ মিনিট লাগতো। একটাতে ছিল ইন্টারনেট সংযোগ, যেখানে বসে তিনি কাজ করতেন। দ্বিতীয় তাঁবুটিতে তিনি ঘুমাতেন। যেটা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা জায়গায়।

তবে যখন শীতকাল শুরু হলো এবং আবহাওয়া ঠান্ডা হতে শুরু করলো তখন তিনি একটা তাঁবুতেই থাকা ও কাজ করার ব্যবস্থা করলেন। কিছু দিন আগে সেখানকার তাপমাত্রা শূন্যের ১১ ডিগ্রি নিচে নেমে যায়। কালিনিন আগে অনুমান করতে পারেননি যে এতটা ঠান্ডা পড়বে ।

তবে এখন দিন দীর্ঘতর হচ্ছে, বরফ গলতে শুরু করেছে। কালিনিনও মনে করছেন, তিনি অন্য আর কোথাও না গিয়ে এখানেই থাকবেন।

কালিনিন এখনো সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার ডাক পাননি। তবে পরিস্থিতি প্রতিদিনই বদলাচ্ছে এবং তার আশঙ্কা ভবিষ্যতে কোনো এক সময় হয়তো তার কাছেও ডাক আসতে পারে।

সরকারি নীতি অনুযায়ী আইটি কর্মীরা সামরিক বাহিনীতে তালিকভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধ্যকতা থেকে মুক্ত। কিন্তু রাশিয়াতে এমন অনেক খবর বেরিয়েছে যে অনেক ক্ষেত্রেই এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সেনাসমাবেশের কথা ঘোষণা করেছিলেন ২১ সেপ্টেম্বর। তার কিছুদিন আগেই ইউক্রেনীয় বাহিনী খারকিভ অঞ্চলে এক দ্রুতগতির পাল্টা অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা রুশ বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করে।

পুতিন বলেছিলেন, পশ্চিমা শক্তির হাত থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করার জন্য অতিরিক্ত সেনাসমাবেশ দরকারি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার ভেতরে অনেকেই এর বিরোধী ছিল। সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তি এড়াতে লাখ লাখ লোক এসময় রাশিয়া ছেড়ে পালাতে থাকে। সীমান্তে তৈরি হয় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

রাশিয়ার সমাজের ওপর এই মোবিলাইজেশনের গভীর প্রভাব পড়েছে। এর আগে পর্যন্ত অনেক রুশ নাগরিক ভেবেছিলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ চললেও তারা আগের মতই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। এটা ঠিক যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আর্থিক লেনদেন কঠিন হয়ে পড়েছিল এবং দোকানপাট থেকে পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমাজের ওপর তার প্রতিক্রিয়া ছিল সামান্য।

কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আদেশ এ যুদ্ধকে অনেক রুশ পরিবারের ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে। অনেক পরিবারের পিতা, পুত্র বা ভাইকে স্বল্প সময়ের নোটিশে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রশিক্ষণ ছিল সীমিত, যুদ্ধের সরঞ্জাম ছিল অপর্যাপ্ত।

রাশিয়ায় অনেকের কাছেই ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল একটা দূরের ব্যাপার। কিন্তু এ ঘটনার পর তাকে উপেক্ষা করার আর কোনো উপায় ছিল না। তারপরও রাশিয়ার ভেতরে প্রকাশ্য প্রতিবাদের ঘটনা ছিল বিরল। ইউক্রেনে এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু কালিনিন বলছেন, প্রতিবাদ করতে গেলে কী বিপদ হয় তা নিয়ে লোকের মনে সঙ্গত কারণেই ভয় ছিল।

তিনি বলেন, ‘এটা একটা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং তারা অত্যন্ত ক্ষমতাধর। গত ছয় মাসে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে অনেকগুলো আইন করা হয়েছে। এখন লোকে যদি যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুখ খোলে তাহলে রাষ্ট্র তাদের পেছনে লাগবে ‘

কালিনিনের এই বনবাসী জীবন অনলাইনে তাকে একটা জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। টেলিগ্রাম এ্যাপে তিনি প্রায় প্রতিদিনই নানা রকম আপডেট দিচ্ছেন এবং তার ফলোয়ারের সংখ্যা এখন ১৭ হাজার। তিনি ভিডিও পোস্ট করেন, তার চারপাশের বনভূমির ছবি দেন, আরো থাকে তার প্রতিদিনের কাজকর্ম, কিভাবে তার ক্যাম্প সাজানো হয়েছে এই সব। এর মধ্যে একটা বড় স্থান নিয়েছে কাঠ কাটা।

কালিনিন দাবি করেন, তিনি তার আগেকার জীবনযাত্রার অভাব খুব একটা বোধ করেন না। তিনি বলেন, তিনি একজন অন্তর্মুখী মানুষ যার একাকী থাকতে অসুবিধা হয় না।

তবে তিনি বলেন, স্ত্রীর জন্য তার মন কেমন করে এবং তাকে তিনি আরো বেশি দেখতে চান। তিনি এটাও বলছেন, যুদ্ধে বা কারাগারে যাওয়ার চাইতে এখন তিনি যেভাবে আছেন সেটা অনেক ভালো।

কালিনিন বলেন, ‘আমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অন্য সময় আমি হয়তো যেসব জিনিসের অভাব বোধ করতাম, এখন তা অনেক দূরের বিষয় হয়ে গেছে। আগে যেসব জিনিস গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো এখন সেগুলো আর আমাকে টানে না। এমন অনেকে আছে যারা আমাদের চাইতেও কঠিন অবস্থায় আছে।’

সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com