রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ভেতরে ভেতরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের নানা প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং শরিক দলগুলোর মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগে নেমে পড়েছেন। এ অবস্থায় জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে। শরিকরা গতবারের চেয়ে এবার বেশি আসন পেতে চাইছে। তাদের লক্ষ্য অর্ধশতাধিক আসন। এ প্রত্যাশার কথা জোটনেত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরবে শরিকরা। তবে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে আসন বণ্টনের চেয়ে জোটকে পুনরায় ক্ষমতায় আনার বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
গত কয়েকদিন ১৪ দলের শরিক দলগুলোর বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ হলে তাদের এই মনোভাব সম্পর্কে জানা গেছে। দলগুলোর নেতারা আমাদের সময়কে বলেন, ১৪ দলের আগামী সভায় আসন বণ্টনসহ নানাবিধ চাওয়া-পাওয়া নিয়ে তারা কথা বলবেন। এর আগে, গত ১৯ জলাই সর্বশেষ ক্ষমতাসীন জোটের নেতাদের সঙ্গে গণভবনে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শরিকদের জানিয়ে দিয়েছেন, যে পরিস্থিতিই হোক আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ১৪ দল জোটগতভাবে অংশ নেবে।
সেই অনুযায়ী ভেতরে ভেতরে শরিকরা আসন ভাগাভাগি নিয়ে দরকষাকষি করছেন। ১৪ দলের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ যেসব আসন ১৪ দলের জন্য ছেড়ে দেবে, সেসব আসনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেবে না। ওইসব আসনে জোট প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনার বিষয়ে কাজ করবে আওয়ামী লীগ। কোন আসন কোন দলের জন্য আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেবে বিষয়টি এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।
জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া না নেওয়ার ওপর জোট ও মহাজোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ নির্ভর করছে। বিএনপি অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট নিয়েই নির্বাচনে যাবে। আর বাকি সব দল থাকবে বিরোধী ভূমিকায়, বিশেষ করে জাতীয় পার্টি ও দেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো। আর বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির একটি অংশ এবং বেশিকিছু ধর্মভিত্তিক দল নিয়ে নির্বাচনী মহাজোট করবে।
যদিও এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপি অংশ নিলেও নির্বাচনের পরিবেশ থাকবে, না নিলেও নির্বাচনের পরিবেশ থাকবে। সুতরাং তাদের নির্বাচনে আসা নিয়ে দেশ ও জাতি উদ্বিগ্ন না, আমরাও না। জোট মহাজোটের রাজনীতি ফিরে আসবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা জোট মাহজোটের রাজনীতিতে যাব এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনও হবে, দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যও হবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা জানান, এবারের নির্বাচন কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হবে। নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের মধ্য দিয়ে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসতে হবে। বিকল্প কোনো পথ নেই। ফলে আবেগে মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ এবার থাকবে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ফের ক্ষমতায় আসতে হলে আসন সংখ্যার দিকে না তাকিয়ে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। সেদিক বিবেচনায় ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের কয়েকটি আসনে শরিকদের না দিয়ে আওয়ামী লীগের ত্যাগী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
শরিক দলের একজন সদস্য জানান, দলের প্রতীকে না গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে গত নির্বাচনের আদলে ১৪ দল মনোনীত প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে শরিকদের কোনো আপত্তি থাকবে না। ১৪ দলের শরিক বা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঠেকানোর কাজটা জোরেশোরে করতে হবে।
এদিকে ১৪ দলের আবশ্যকতা ও তাদের মনোনয়ন প্রত্যাশা নিয়ে শরিক দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলেন, এই জোট না থাকলে ফের সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল রাখতে এই জোটের আবশ্যকতা আছে বলে মনে করেন জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি আমাদের সময়কে জানান, আগামী নির্বাচনে তাদের দল থেকে অন্তত ১০টি আসন চাওয়া হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিকে পাঁচটি আসন দেওয়া হয়েছিল।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদও (ইনু) গত নির্বাচনের তুলনায় এবার আসন সংখ্যা বেশি চাইবে। জানতে চাইলে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু আমাদের সময়কে বলেন, ‘মনোনয়নের বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। তবে আমরা আগের তুলনায় বেশি আসন চাইব।’ প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাসদকে তিনটি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়–য়া জানান তিনি আগামী নির্বাচনে একটি আসন চাইবেন। এর আগের নির্বাচনেও তিনি একটি আসন চেয়েছিলেন।
গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন জানান, তারা এখনো মনোনয়নের বিষয়ে চিন্তা করেননি। জানা গেছে, তারা মনোনয়ন চাওয়ার চেয়ে জোটের সঙ্গে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তারাও অন্তত দুটি আসন চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. অসিত বরণ রায় জানান, আগামী নির্বাচনে তারা দুটি আসন চাইবেন। এর আগের নির্বাচনে তারা আসন চেয়েও পাননি।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান জানান, তারা পাঁচটি আসন চাইবেন। এর আগে তারাও কোনো আসন পাননি।
তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী জানান, তারা ১০-১৫টি আসন চাইবেন। তবে মনোনয়ন প্রত্যাশার চেয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনাকেই বেশি গুরুত্ব দেবেন।
জাতীয় পার্টি (জেপি)-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম জানান, তারা আসন চাওয়ার বিষয়ে এখনও ভাবেননি। তিনি জানান, এর আগে দুটি আসন চাওয়া হয়েছিল, একটি আসন দেওয়া হয়।
গণ-আজাদী লীগের সভাপতি এসকে শিকদার জানান, আসন চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ে তারা দলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। এই মুহূর্তে পাঁচটি আসনের ভাবনা আছে বলে জানা গেছে। গত নির্বাচনে তাদের দল জোট থেকে কোনো আসন পায়নি।
ন্যাপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন জানান, তারা গত নির্বাচনে কোনো আসন পায়নি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিল ৯ জন। এবার এখনো আসনের বিষয়ে দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টির সভাপতি জাকির হোসেন জানান, তারা পাঁচটি আসন চাইবেন। এর আগের নির্বাচনে তারা কোনো আসন পাননি।