মঙ্গলবার, ০৩:৫২ পূর্বাহ্ন, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

আরেক দফা কাটছাঁট খাদ্য তালিকায়

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২
  • ৮০ বার পঠিত

করোনার ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে মানুষ। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অস্থির করে তুলেছে আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার। যুদ্ধের বড় প্রভাব পড়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে, যার আঁচ লেগেছে দেশেও। দেশে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় অনেক বাড়ানো হয়েছে। প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ ও পেট্রলে ৪৪ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানির এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও একধাপ উসকে দিয়েছে। মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের দামসহ জীবনযাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের খরচের চাপ শুধু বাড়ছেই। এতে দিশেহারা মানুষ টিকে থাকতে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হচ্ছেন। টিকে থাকতে মৌলিক চাহিদাতেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। করোনাকালে এক দফা খাবারের খরচ কমাতে হয়েছিল সীমিত ও নি¤œ আয়ের পরিবারগুলোকে। এবার অতিমুল্যস্ফীতির চাপে খাদ্য তালিকায় আরেক দফা কাঁচি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষকে এভাবেই জীবনযাত্রার গতিপ্রবাহ ঠিক করতে হচ্ছে।

রাজধানীর কদমতলী এলাকায় বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে মাসে ১১ হাজার টাকা আয় করেন মোসাম্মত লিপি বেগম। আয়ের এই সামান্য টাকা দিয়ে বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল এবং এক ছেলে ও এক মেয়ের পড়াশোনার খরচ সামাল দিতেই খেই হারিয়ে ফেলছেন স্বামী পরিত্যক্তা মধ্যবয়সী এ নারী। এর পর হাতে যে কটা টাকা থাকে তা দিয়ে মাসের বাজার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারেন না তিনি। বাধ্য হয়ে পরিবারের খাওয়া কমিয়ে দিতে হয়েছে তাকে।

কথা হলে লিপি বলেন, ‘করোনাকালেও খাওয়া-দাওয়ায় কষ্ট করতে হয়েছে। তখন অন্তত চাল, ডাল, তেল, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, তরিতরকারি কিনে খেতে পারছিলাম। কিন্তু এখন ঋণ করেও বাজার খরচ কুলাচ্ছে না। ব্রয়লার মুরগি, ডিম, ডাল, পেঁয়াজ-রসুন, মসলার দাম সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। মাছ-মাংস একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি বলতে গেলে।

ছেলেমেয়েকে নিয়ে সামান্য আলুভর্তা আর ডিম ভাজি খাব, তাতেও অনেক খরচ পড়ছে। এখন কেবল ডাল-ভাত আর কম দামি শাকসবজি খেয়ে দিন পার করছি।’

মগবাজার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে রাস্তার ধারে হোটেলে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন রিকশাচালক আল-আমিন। তিনি বলেন, ‘আগে আলুভর্তা, ডাল আর ভাত খেতে ৩০ টাকাও খরচ হতো না। ইচ্ছে হলে একটা ডিমের তরকারি কিনে খাওয়ার সাহস করতাম। এখন তা পারি না। এখন ভর্তা-ডাল দিয়েই ভাত খেতে ৪০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। খরচ বাঁচাতে প্রায় দিনই একটা বিস্কুট আর এক কাপ চা দিয়েই দুপুরটা পার করে দিই।’

কেবল নিম্নআয়ের মানুষ নয়, বাজারের উত্তাপে পুড়ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও। রাজধানীর কোনাপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট সংযোগ, পোশাক, অফিস যাতায়াত, ছেলেদের পড়াশোনাÑ এসব খরচ কমানোর সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়ে খাওয়ার পেছনেই খরচ কমাতে হচ্ছে। এখন ব্রয়লার মুরগি কিনতেও হিসাব করতে হচ্ছে। চলতি সপ্তাহ থেকে ডিম খাওয়াও বন্ধ রেখেছি। উপায় নেই। চাল, ডাল, তেল কিনতেই পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ঋণ করেও কুলানো যাচ্ছে না।’

সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেশি বলে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির যে হিসাব, এটি আসলে ধনী-গরিব নির্বিশেষে গড় হিসাব। গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকে। আমি মনে করি, তাদের ওপর প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের মতো আছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানুষের আয় না বাড়লে প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। নিত্যপণ্যের দাম অসহনীয় পর্যায়ে বাড়লে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে বাধ্য হয়ে খাওয়ার পেছনে খরচ কমাতে হয়। এর ফলে অসংখ্য পরিবার অপুষ্টিতে ভুগবে, যা দীর্ঘমেয়াদে কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতায় প্রভাব ফেলবে।’

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি যা, তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন। তবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের কষ্ট লাঘবে উদ্যোগ নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং প্রকৃত সুবিধাভোগীরা যাতে উপকৃত হন তা নিশ্চিত করতে হবে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, এমনটি যেন না হয়।

গত ৫ জুন বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (বিআইজিডি) এক গবেষণায় জানায়, করোনাকালে দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। করোনার প্রকোপ কমায় এ সংখ্যা কমে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) গত ২৭ জুলাই এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় বর্তমানে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে ৩ শতাংশের বেশি। মূল্যবৃদ্ধি প্রভাব ফেলেছে মানুষের কেনাকাটার সার্ম্যথে জাতীয় পর্যায়ে মানুষের কেনাকাটা বা ব্যয় প্রায় ৫ শতাংশ কমে গেছে।

বাজার চিত্র বলছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ৩ টাকা। গুড়া দুধের দাম কেজিতেও ৫০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মসুর ডালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। আমদানিকৃত রসুনের দাম বেড়ে এখন ১৩০ টাকা কেজি। আদার কেজি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। খোলা চিনিতেও কেজিপ্রতি ৫ টাকা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়। দাম বেড়েছে পেঁয়াজেরও। গরুর মাংস ও মাছের দাম অনেক আগেই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সয়াবিন তেল কিনে খেতেও ঘাম ছুটছে কপালে।

এরই মধ্যে সম্প্রতি লাফিয়ে বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম। ব্রয়লারের কেজি ১৯৫ থেকে ২১০ টাকা পর্যন্ত এবং ফার্মের ডিমের ডজন ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস ব্রয়লার ও ডিমের দাম এত হারে বেড়ে যাওয়ায় পণ্য দুটি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে অনেক পরিবার।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন মানুষের প্রতিদিনের খাবারে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শর্করা, ১৫ শতাংশ প্রোটিন ও ৩০-৩৫ শতাংশ স্নেহ জাতীয় খাবার প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় হলে স্বাভাবিকভাবেই তা স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। কম খেলে বা সুষম খাবারের ঘাটতি হলে তা সরাসরি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খুরশিদুল জাহিদ। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, অতিমূল্যস্ফীতির ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাজারে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ায় স্বাভাবিকভাবেই স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমেছে এবং তারা বাধ্য হচ্ছেন খাদ্যতালিকা থেকে মূল্যবান খাবার বাদ দিতে। আবার অনেক দরিদ্র পরিবার বাধ্য হচ্ছেন কম খাবার খেতে। এর ফলে অনেকের খাদ্যতালিকা থেকে  ও প্রোটিনের উৎসগুলো বাদ পড়ছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় স্বল্প আয়ের মানুষ ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উননে পড়েছে বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, করোনায় এমনিতেই মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এসব অসহায় মানুষের টিকে থাকাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। বাধ্য হয়ে মানুষ কম খাচ্ছে, সাশ্রয়ী হতে প্রয়োজনীয় অনেক খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ পড়ছে। এটা অমানবিক।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com