‘আমার পাখি উড়ে গেছে। দুনিয়ায় আমার আর কিছু থাকল না। কীসের আশায় বাঁচব, কাকে নিয়ে বাঁচব আমি। ’ -এই বলেই বিলাপ করছেন পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা এলাকায় বাসচাপায় নিহত মো. বাদশা শেখের (১৭) মা জরিনা বেগম। সন্তানের শোকে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি।
শুক্রবার (১৭ মার্চ) বিকেলে নসিমনে করে বাগেরহাট থেকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় নিহত হন মো. বাদশা শেখ। এই দুর্ঘটনায় নসিমনে থাকা ১৮ জনের মধ্যে বাদশাসহ পাঁচজন নিহত হন।
নিহত বাদশা শেখ বাগেরহাট শহরের মুনিগঞ্জের মালোপাড়া এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত দবির উদ্দিনের ছেলে। কচুয়া উপজেলার গোয়ালমাঠ রশিকলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ত বাদশা শেখ। ১৮ মাস বয়সে বাবাকে হারায় সে।
সাংসারিক জটিলতা থাকায় একমাত্র সন্তান বাদশাকে নিয়ে বাবা আফছার পাইকের বাড়ির পাশে পালপাড়া এলাকায় ভাড়া থাকা শুরু করেন মা জরিনা বেগম। দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর স্বামী ছাড়াই ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন অসহায় এই মা।
জরিনা বেগম বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর কলিজার টুকরো বাদশাকে নিয়ে বেঁচে ছিলাম। অনেক কষ্ট করে বাদশাকে বড় করেছি। সে ছাড়া আমার পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না। ওকে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন ছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়েও করিনি।
তিনি বলেন, বাদশা সব সময় বলত- ‘এসএসসি পাস করলেই তোমার আর কষ্ট হবে না মা। পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে আমার চাকরি হয়ে যাবে। তখন তুমি শুধু শান্তি করবা। ’ আমার বাবা একবারে পাস করে গেছে, এখন তাকে নিয়ে আমার আর কষ্ট হবে না- এই বলে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নিহত বাদশার মা জরিনা বেগম।
এই দুর্ঘটনায় নিহত বাকিরা হলেন, বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার পালপাড়া গ্রামের আল আমিন মল্লিকের ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী শাহিন মল্লিক (১৭), মাঠ রাড়িপাড়া এলাকার আব্দুল কাদের মোল্লার ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী শাহিন মোল্লা (১৮), মোরেলগঞ্জ উপজেলার চোমড়া এলাকার হালিম শেখের ছেলে সাব্বির শেখ (১৬), একই এলাকার আবুল মিনার ছেলে ইয়াসিন মিনা (১৬)।
সাব্বির গোয়ালমাঠ রশিক লাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে এবং ইয়াসিন মিনা যদুনাথ স্কুল অ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। এই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সিরাজুল ইসলাম শিমুল, অনিক দত্ত ও বনি আমিন নামের তিনজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শনিবার বিকেলে নিজ নিজ বাড়িতে নিহতদের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। নিহত শাহিন মল্লিকের মা পেয়ারা বেগম বলেন, নৌবাহিনীতে আবেদন করেছিল আমার বাবা শাহিন। বাবার আর চাকরি করার স্বাদ মিটল না। কোনো মায়ের সন্তান যেন নসিমনে না ওঠে- এই বলে বারবার বিলাপ করছিলেন এই মা।
একমাত্র ভাইকে হারিয়ে কান্না থামছে না নিহত শাহিন মোল্লার ছোট দুই বোনের। শাহিনের বোন সেজুতি আক্তার বলে, আমরা দুই বোন এক ভাই। শাহিন ভাইই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই আব্বা ও মা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো কথাও বলছেন না।
কী হবে আমাদের- এই বলে আবারও কান্না শুরু করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সেজুতি আক্তার। পাঁচজনের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে স্থানীয়দের মাঝে। নিহতদের পরিবারকে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ইকবাল মোল্লা বলেন, যারা মারা গেছে প্রত্যেকের পরিবার খুবই অসহায়। মাত্র একশ টাকার জন্য এরা ক্যাটারিং সার্ভিস দিতে গিয়েছিল। এক কথায় একশ টাকা আয় করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তারা।
কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. তাছমিনা খাতুন বলেন, নিহতের পরিবারের খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছে। তাদের পাশে থাকবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থাকবে। আইনের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।