আবারো সেই ডাণ্ডাবেড়ির নিষ্ঠুর গল্প শুনতে হলো আমাদের। এবারের স্থান শরীয়তপুর। হাতকড়া আর ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নিলেন সেলিম রেজা নামে ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা। মায়ের মৃত্যুতে কারাগার থেকে পেরোলে মুক্তি পেলেও জানাজার সময় তার হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। গত ১৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে শরীয়তপুর সদর উপজেলার সুজনদোয়াল গ্রামে সেই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মসজিদের কবরস্থানে তার মাকে দাফন করা হয়।
পেরোলে মুক্তি ও ডাণ্ডাবেড়ির পরও দুঃখের বিষয় সেলিম রেজা মায়ের কবরে মাটি দিতে পারেননি। এর আগে আরেকটি ডাণ্ডাবেড়ির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। গত ২০ ডিসেম্বর তিন ঘণ্টার জন্য পেরোলে মুক্তি পেয়েছিলেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি আলী আজম। নিজ বাড়িতে নেয়ার পর তিনি নিজেই মায়ের জানাজা পড়ান। এ সময়ে তার হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরানো ছিল। ওই ঘটনা নিয়েই রাজনৈতিক মহলে ও গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিভিন্ন সংগঠন এর নিন্দা করে। সেই ঘটনার পর এক মাস যেতে না যেতেই আরেকটি নির্মম ডাণ্ডাবেড়ির ঘটনা প্রত্যক্ষ করল জাতি।
সেই ঘটনার সাথে এই ঘটনার হুবহু মিল রয়েছে। সদর উপজেলার আনোয়ার হোসেন মুন্সির ছেলে সেলিম রেজা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক। গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পুলিশ তাকে আটক করে। ১০ ডিসেম্বর পল্টন থানার নাশকতার একটি মামলায় সেলিম রেজাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি গাজীপুরের কাশিমপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, এর মধ্যে সেলিম রেজার মা নাসিমা বেগম গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। আইনজীবীর মাধ্যমে সেলিম রেজার পেরোলে মুক্তির জন্য ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করা হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেলিম রেজাকে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ১০ ঘণ্টার জন্য পেরোলে মুক্তি দেয়া হয়।
গাজীপুর জেলা পুলিশ সেলিম রেজাকে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে শরীয়তপুরের সুজনদোয়াল গ্রামে নিয়ে আসে। সেখানে তার মায়ের লাশ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন স্বজনরা। গভীর রাতে মসজিদ মাঠে জানাজায় অংশ নেন তিনি। পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা রাত ৩টার দিকে তার মায়ের দাফন করেন। স্থানীয় পুলিশ দায় এড়িয়ে বলে, কর্তৃপক্ষের আইনানুগ সহায়তা দিয়েছে মাত্র, এতে তাদের দায় নেই। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেরোলে মুক্তি দেয়ার পর কারা কর্র্তৃপক্ষ থেকে পুলিশের জিম্মায় আসামিকে আনতে হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে আসামিকে হাতকড়া পরানো হয়েছিল।
সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, যেমন করে সাদামাটা করে পুলিশ বলছে সেটি হয়তো সত্য নয়। এসব ক্ষেত্রে আসামির ব্যক্তিগত অবস্থান, আচার-আচরণ ও অপরাধের ধরন বিবেচনা করা হয়। সেলিম রেজা কখন কিভাবে গ্রেফতার হয়েছে তা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। ৭ ডিসেম্বর পুলিশ বিএনপি অফিসে যে তাণ্ডব চালায় তারই ফলে অসংখ্য নেতাকর্মীর সাথে সেলিম রেজাকেও গ্রেফতার করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি কোনো ক্রিমিনাল মামলার আসামি নন। তিনি চুরি-ডাকাতির আসামি নন। তিনি একজন রাজনৈতিক বন্দী মাত্র। ১০ ডিসেম্বর যে মামলা সেলিম রেজার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই মিথ্যা, বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ দেশে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের এখন এরকম হাজারো মামলা দেয়া হয়েছে। গায়েবি মামলা নামে এই মামলাগুলো দেশজোড়া কুখ্যাতি কুড়িয়েছে। এত কিছুর পরও এই ঘটনা প্রমাণ করে, কারা কর্তৃপক্ষ, পুলিশ বা জেলা প্রশাসন যারাই এ ধরনের পেরোলের সাথে জড়িত তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না। না হলে একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এ ধরনের আরেকটি ঘটনা কিভাবে পুনরায় ঘটে?
আগেকার ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিসকেন্দ্র-আসক বিবৃতি দিয়ে বলেছিল- এ ঘটনা কেবল অমানবিকই নয়; বরং মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বা দণ্ড দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না, কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডাণ্ডাবেড়ি না পরানোর বিষয়ক উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে।
আলী আজম ও সেলিম রেজার ব্যাপারে অবশ্যই প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, তারা সুনির্দিষ্ট মামলার আসামি নন। তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা রয়েছে তা যে রাজনৈতিক সেটি নাবালকও বোঝে। আলী আজমের ব্যাপারে ইতঃপূর্বে গাজীপুরের জেল সুপার ঔদ্ধত্যের সাথে বলেছিলেন, আসামি জেলের বাইরে গেছে তাই নিরাপত্তার জন্য ডাণ্ডাবেড়ি দিয়েছি। ওয়ারেন্টি দাগি-নিদাগি কোনো কিছু বলা থাকে না। আমি শুধু মামলার ধারাগুলো দেখি। সেকশনে আছে- বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ৩, ৪, ৫ ধারা, বিস্ফোরক আইনের মামলা আমি কি ছোট করে দেখব? ওখানে যারা তাকে নিয়ে গেছিলেন তাদের ডাণ্ডাবেড়ি খোলার সুযোগ ছিল না। তাদের কাছে এর চাবিও ছিল না। আমরা আইনের বাইরে কোনো কাজ করিনি।
মানবাধিকার সংগঠনের পরবর্তী অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই কর্মকর্তার উক্তি অসত্য। যে মামলায় আলী আজমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, ওই মামলার এজাহারে তার নাম নেই। মামলার এজাহারের কপি সংগ্রহ করে দেখা গেছে, ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে আলী আজম নামটি নেই। এ ছাড়া অজ্ঞাত হিসেবে ১৫০ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। রিমান্ডের আবেদন করেছিল, কিন্তু আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেননি। এই দু’জনের ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট, যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে, ডাণ্ডাবেড়িও সে অন্যায়ভাবে পরানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের ভ‚মিকা নিয়ে আজকাল প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। তারা জনগণের পুলিশ নাকি বিশেষ দলের পেটোয়াবাহিনী, সে প্রশ্ন আসছে।
পুলিশের এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণের কারণেই সেই সময় তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, ডাণ্ডাবেড়ি খুলে দিলে ভালো হতো। এ দেশের মানুষ মানবিকতা সহৃদয়তা কোনো পরিচয় পুলিশের কাছ থেকে পেলো না। এবার সেলিম রেজার বিষয়টি দেখা যাক। তিনি ঢাকার দনিয়াতে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। রাজনীতি করেন। তার পরিবার ও পরিপার্শ্ব থেকে বলা হয়, কোনো নাশকতার সাথে কখনো জড়াননি তিনি। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের আগে যেভাবে গণহারে পুলিশ নেতাকর্মীদের আটক করেছিল সেলিম রেজা সে ক্ষেত্রে একটি ভিকটিম মাত্র। সেলিম রেজার ভাই শামীম মুন্সি বলেন, একজন সন্তান হিসেবে তিনি স্বাভাবিকভাবে মায়ের জানাজা ও দাফনে অংশ নিতে পারেননি। তার হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি খুলে দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম কিন্তু পুলিশ তা শুনেনি।
বাংলাদেশে পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার নতুন নয়। বিদ্বজনরা বারবারই বলে আসছেন, সেই ঔপনিবেশিক আমলের উত্তরাধিকার থেকে যে পুলিশ বাহিনী এসেছে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তান আমলে যে আধা উপনিবেশ ছিল এ দেশ, সেখানেও কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। দুঃখের বিষয় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর যে পুলিশ বাহিনী আমরা পেলাম তারাও শিগগিরই রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহে পরিণত হলো। উপর তলা থেকে উপদেশ বর্ষণ করা হয়েছে কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আদর্শ এবং নীতিগত কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো বারবারই মৌলিক স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিয়েছে। কাজ করেছে বিপরীতটি।
আওয়ামী লীগ যে সংবিধান প্রণয়ন করল তা মানবাধিকারের অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে ভরপুর। কিন্তু তারাই ’৭৩ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করে অবশেষে বাকশালে লীন হলো। বিস্ময়ের ব্যাপার অনেক বছর পরে তারা যখন আবার ক্ষমতায় এসেছে সেই কালাকানুন, সেই কালো আচরণ ও কালো অধ্যায়ের আবার সূচনা হয়েছে। বিশেষ করে বিগত দেড় যুগ ধরে তারা যে ক্ষমতা প্রয়োগ করছে তা কেবলই শক্তিনির্ভর। শক্তি মদমত্ততার কারণে আইন-কানুন, রীতি-রেওয়াজ, ভদ্রতা-সভ্যতার একপ্রকার অবসান ঘটেছে। উপরের দুটো ঘটনা তারই প্রমাণ দেয়। নাগরিক সাধারণ পুলিশের কাছে যে মানবিকতার দাবি করে তা তেঁতুলগাছ থেকে মিষ্টি আম খাওয়ার প্রত্যাশা মাত্র।
জাতীয়ভাবে আমাদের লজ্জার বিষয়, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণের কারণে বিদেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসছে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার এই, আমাদের সরকার এই ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের রাজনৈতিক মহল বারবার দাবি করে আসছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ রকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অমানবিক আচরণের কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। পুলিশ কর্মকর্তা পুরস্কৃত হয়েছে বিরোধী নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে লাঠিপেটা করার কাজে। পুলিশ পদক পেয়েছে এমন সব কর্তা যারা বিরোধী দলকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়েছে। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা রাজনীতিকের মতো কথা বলেন এবং সেভাবেই আচরণ করেন। পুলিশ কি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয়? কবে হবে এদের এই বেপরোয়া আচরণের অবসান?
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়