কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আজ মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ পাঠ করার কর্মসূচি দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। পরে গতকাল সোমবার মধ্যরাতে সংগঠন দুটির এক জরুরি সভায় ঘোষণাপত্র পাঠ স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এ উপলক্ষে পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করার যে ঘোষণা সরকারের দিক থেকে দেওয়া হয়েছে, সেটিকে সমর্থন জানিয়েছেন সংগঠন দুটির নেতারা। রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ণ সেন্টারে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আজ মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির যে ‘জুলাই বিপ্লব’-এর ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার কথা ছিল তা স্থগিত করা হয়েছে।
সেক্ষেত্র তারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করার যে ঘোষণা সরকার দিয়েছে, সেটা তারা সমর্থন দেবে। তবে, শেখ হাসিনার বিচার দ্রুত করতে দাবি জানাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সংগঠনটির মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি বলেন, ঘোষণাপত্রের বিষয়ে দেশি-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। যে ষড়যন্ত্র হয়েছে, তাতে পেড়েক মেরে দিয়েছে সরকার। সরকার আমাদের প্রক্লেমেশনের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে, আমাদের বিজয় হয়েছে। আমরা অবশ্যই শহীদ মিনারে একত্রিত হব। যে কর্মসূচি আমরা দিয়েছি, আমরা একত্রিত হব। সরকার প্রক্লেমেশনের পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছে, আমরা শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে তাতে সমর্থন জানাব। প্রক্লেমেশন কীভাবে হবে কালকে আমরা সেখানে বলে দেব।
এর আগে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানান, ৩১ ডিসেম্বর এই ঘোষণাপত্র এলেও তা ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এটাকে তারা বলেন, ৩৬ জুলাই এসে মিলবে ৩১ ডিসেম্বরে। ইতোমধ্যে ঘোষণাপত্রের খসড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে এটি চূড়ান্ত করা হবে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে এই বিপ্লবকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি চাওয়া হবে। আন্তর্জাতিকভাবেও এর স্বীকৃতি আদায় করা হবে। এ ছাড়া এ ঘোষণাপত্রকে সংবিধানে লিপিবদ্ধের দাবি জানানো হবে।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’কে স্বীকৃতি দেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। একই সঙ্গে বাহাত্তরের সংবিধানকে ফ্যাসিবাদী সংবিধান আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি জানাবে। এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকাকে বড় করে দেখানো হবে।
ঘোষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫৮ জন সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়ক শপথগ্রহণ করার কথা ছিল। শপথ পড়ানোর কথা উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম কিংবা শহীদ পরিবারের সদস্য।
অনুষ্ঠানে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের সদস্য, ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষাবিদসহ সমাজের নানা শ্রেণি- পেশার মানুষ উপস্থিত থাকবেন বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল। সরকারের উপদেষ্টারাও উপস্থিত থাকতে পারেন বলে জানানো হয়েীছল। তবে আজ ঘোষণাপত্র পাঠ না হলেও আজকের সমাবেশে লাখো ছাত্র-জনতার উপস্থিতি প্রত্যাশা করছেন তারা।
গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত নেতারা বলেন, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণীত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে বিবেচিত। এটা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত গণপরিষদের ৪০৪ জন সদস্য কর্তৃক স্বাক্ষরিত ও অনুমোদিত, যা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে পূর্ণাঙ্গরূপে উপস্থাপিত হয় এবং ইতিহাসে এক অনন্য আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এটাকে তারা স্বীকৃতি দেবেন। সেক্ষেত্রে ’৭২ সালের সংবিধানকে ফ্যাসিবাদী সংবিধান হিসেবে আখ্যা দেওয়া হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, বিপ্লবের পর তাৎক্ষণিক এই ঘোষণা আসার দরকার ছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোরও অসহযোগিতা ছিল। এই ঘোষণা না থাকলে গণ-অভ্যুত্থানকে স্যাবোটাইজ করার আশঙ্কা থাকে। সর্বোপরি, বিপ্লবের বছরেই একটি লিখিত ঘোষণাপত্র থাকতে হয়। এমন বাধ্যবাধকতায় ৩১ ডিসেম্বর এই ঘোষণাপত্র পাঠ করার সিদ্ধান্ত হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলা হয়েছিলম, ঘোষণাপত্রে পরবর্তী বাংলাদেশের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা, লক্ষ্য ও ইশতেহার লিপিবদ্ধ থাকবে। আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে। এ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের দাবি জোরালো করা হবে। গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে যে গণ-আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটির প্রাতিষ্ঠানিক ও দালিলিক স্বীকৃতির বিষয় থাকবে এ ঘোষণাপত্রে।
জানা গেছে, প্রস্তুত করা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে মোট ২৯টি ধারা থাকছে। ঘোষণাপত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে স্বাধীনতা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য, স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতাপরবর্তী গণতান্ত্রিক অবক্ষয়, ’৭২ সালের সংবিধানে লাখ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের প্রতিফলন না হওয়া, সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব, কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেন বন্দোবস্ত ও মুজিববাদী দৃষ্টান্তকে স্থায়ীকরণ, শেখ হাসিনার প্রশ্নাতীত ক্ষমতা ও আধিপত্যের পথ প্রশস্তকরণ, একাত্তরের চেতনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিগত সরকারের মুজিববাদ ও ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ জিইয়ে রাখার বিষয় উল্লেখ রাখা হয়।
এ ছাড়া সামরিক, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ; দুর্নীতি ও দমনমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার হাতিয়ারকরণ; সংখ্যালঘু ও নারীদের ফ্যাসিবাদী শাসনের লক্ষ্যে পরিণতকরণ, সাড়ে ১৫ বছরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিতকরণ; রাজনৈতিক কারণে বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জেল-জুলুম, পিলখানা ষড়যন্ত্র, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড, প্রহসনমূলক বিচারব্যবস্থা, বাংলাদেশপন্থি অবস্থানের জন্য ভারতবিরোধীদের নির্যাতন, শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সমন্বয় করে ব্যবসায়ীদের অর্থপাচার, ন্যায্য দাবি তুললে শ্রমিকদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা, ক্যাম্পাসগুলোতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হাতে শিক্ষার্থী ও তরুণদের নির্যাতন, জুলাই বিপ্লবে সরকারের নৃশংস বলপ্রয়োগ ও ছাত্র হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হবে।
এ ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-মর্যাদা, সাম্য, ন্যায়বিচার পুনরুদ্ধার করা; সংসদ ও হাসিনার শাসন দ্বারা মনোনীত বা নির্বাচিত সমস্ত দপ্তর ভেঙে দেওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরা হবে। এ ঘোষণাটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুর রহমান তুহিন আমাদের সময়কে বলেন, প্রত্যেকটা বিপ্লব বা যুদ্ধের ঘোষণাপত্র থাকে। কিন্তু ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি দ্রুত এগোতে থাকায় ঘোষণাপত্র দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেটাই এখন আমরা দিতে যাচ্ছি।
সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, ৫ আগস্টই এই ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নানান বাস্তবতায় সেটি সম্ভব হয়নি। আমরা এই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানাব।
ডিএমপির ট্রাফিক নির্দেশনা
আজ শহীদ মিনারের এই ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে ট্রাফিক নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি। গাবতলী হয়ে ঢাকা মহানগরে প্রবেশকৃত যানবাহনগুলো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আগারগাঁও এলাকার পুরাতন বাণিজ্যমেলা মাঠে পার্কিং করবে; সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী প্রবেশপথ দিয়ে আগত যানবাহনগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় পার্কিং করবে এবং আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রবেশকৃত যানবাহনগুলো ৩০০ ফিট এলাকায় পার্কিং করবে।