আজ একই দিনে ঢাকা আসছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সহকারী মন্ত্রী মিশেল সিসন। চীনের জোরালো হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে করে সৃষ্ট সামরিক উত্তেজনা পূর্বনির্ধারিত এই সফর দু’টিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। আর নতুন এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখাকে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
চীনের তীব্র আপত্তিকে উপেক্ষা করে ন্যানসি পেলোসি গত মঙ্গলবার তাইওয়ান সফর করেন। ১৯৮৯ সালে তিয়েনেনমান স্কোয়ারে গণতন্ত্রপন্থীদের কঠোর হাতে দমন থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে চীনের সমালোচনায় মুখর ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এই রাজনীতিক। আর এ কারণে আগে থেকেই তিনি চীনের চক্ষুশুল ছিলেন। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসাবে পেলোসির তাইওয়ান সফরে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয় চীন। এরপর তাইওয়ানকে ঘিরে চীন নজিরবিহীন সামরিক মহড়া শুরু করে। ন্যানসি পেলোসি ও তার পরিবারের ওপর আরোপ করে নিষেধাজ্ঞা। এর পাল্টা হিসেবে ভারতকে সাথে নিয়ে চীন সীমান্তের কাছে যৌথ মহড়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
তাইওয়ানকে নিজ দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে চীন। অন্য দিকে চীনের সামরিক অভিযানের মুখে তাইওয়ানকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাইওয়ানের স্বাধীনতাপন্থী দল বর্তমানে তাইপের ক্ষমতায় রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিস স্টাডিসের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব:) এ এন এম মুনিরুজ্জামান বলেছেন, তাইওয়ানকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ভারত-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল এবং এর বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। আঞ্চলিক উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর এর গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন- উভয়েই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। দুই দেশের এই উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশকে অবশ্যই কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। তবে এটা অনেকাংশেই নির্ভর করছে আমাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর।
তিনি বলেন, ন্যানসি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কে গুরুতর অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিশেষ করে বিশ্বের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব ইতোমধ্যে গুরুতর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় শক্তির লড়াই এই ঝুঁকি ও অস্থিরতাকে আরো বাড়িয়ে দেবে।
মুনিরুজ্জামান বলেন, ভূ-কৌশলগত চাপ চীন-ভারত সীমান্তে অনুভূত হতে পারে। আর সেটা হলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। তাইওয়ান পরিস্থিতির অবনতি হলে চীনের সহায়তায় বাংলাদেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ এখন এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। চীনের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কোনো ধরনের বাধা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই আগে থেকেই চলছে। আর এই লড়াইয়ে দুই দেশই বাংলাদেশকে পাশে পেতে চাইছে। তবে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সতকর্তা বজায় রেখে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে থাকতে চাইছে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া কৌশলে বাংলাদেশ যুক্ত হতে চায় ঠিকই; কিন্তু সামরিক নয়, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে। অন্য দিকে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্য সম্প্রসারণে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে বাংলাদেশ আগে থেকে যুক্ত রয়েছে। চীন বেল্ট অ্যান্ড রোডের পাশাপাশি আরো কয়েকটি উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই)। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরকালে নতুন উদ্যোগগুলো উত্থাপন করলে বাংলাদেশ তা বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে প্রতিমন্ত্রী বলেন, চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড বা তার কোনো নতুন উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে আমাদের আপত্তি থাকবে না। তবে বিশ্বের অন্য বলয়গুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কি হবে সেটি আমাদের ইস্যু। আমরা নিজেদের জনগনের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবো। এটি নিয়ে আমরা কারো উপদেশ বা নির্দেশনা প্রত্যাশা করি না।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমেদ বলেন, আমার বিবেচনায় ওয়াং ই’র সফরে দু’টি বড় বিষয় প্রাধান্য পাবে। প্রথমটি হচ্ছে দ্বিপক্ষীয়, যেখানে দুই দেশের বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু যেমন, প্রকল্প, রোহিঙ্গা ও অন্যান্য বিষয় রয়েছে। দ্বিতীয়টি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত সঙ্কট, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। বর্তমান বিশ্বে খাদ্য ও জ্বালানি সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠছে। এর ফলে সব দেশ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, যার ফলে বাণিজ্য প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। গোটা বিষয়টি যদি বিবেচনা করা হয় তবে দেখা যাবে বৈশ্বিক বিষয়গুলো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে।
নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর সাথে যোগ হয়েছে ডলার সঙ্কট, যা আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এখন ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে (চীনের মুদ্রা) বাণিজ্য করা সম্ভব কি না সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কারণ রাশিয়ার সাথে অনেক দেশ রুবলে বাণিজ্য করছে।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ওয়াং ই’র সফরে চীনের নতুন দু’টি উদ্যোগ জিএসআই এবং জিডিআই নিয়ে আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। চীন নিশ্চয়ই তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবে। অন্য দিকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল নিয়ে বাংলাদেশ কি ভাবছে- চীন তা জানতে চাইতে পারে।
দুই মন্ত্রীর সফর : চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই দুই দিনের সফরে আজ ঢাকা আসছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মানে যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছেন। এই সফরে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হওয়ার কথা রয়েছে।
অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সহকারী মন্ত্রী মিশেল সিসন আজ দিল্লি থেকে ঢাকা আসছেন। তিনি খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার ও মানবিক চাহিদা, শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণ এবং রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রতি সমর্থনসহ যুক্তরাষ্ট্রের বহুপক্ষীয় অগ্রাধিকার নিয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করবেন। সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় তিনি জাতিসঙ্ঘে সহযোগিতা গভীরতর করার ওপর গুরুত্ব দেবেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) পরবর্তী মহাসচিব পদের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রার্থীর প্রতি সমর্থন চাইবেন। নাগরিক সমাজের নেতাদের সাথে আলোচনায় মিশেল সিসন জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশগুলো কিভাবে একত্রে কাজ করতে পারে তা নিয়ে মতবিনিময় করবেন।