রবিবার, ১২:০৬ অপরাহ্ন, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

বিলকিস বানু মামলার আসামিদের খালাস ন্যায়বিচারের সাথে মশকারা

মাসুম মুরাদাবাদী
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ১০১ বার পঠিত

বিলকিস বানু মামলার আসামিদের খালাস দেশে এক নতুন বিতর্ক জন্ম দিয়েছে। এ বিতর্কের কেন্দুবিন্দু সেই মজলুম নারী, যাকে এ দেশে রাত-দিন পাশবিক ধর্ষণের শিকার বানানো হয়েছে। দেশে এক দিকে নারীর ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার পক্ষে বড় বড় কথা বলা হচ্ছে, আবার অপর দিকে সেই হিংস্র নেকড়েদের দয়ার যোগ্যও ভাবা হচ্ছে, যারা কিনা এ ধরনের ঘৃণ্য অপকর্মের সাথে জড়িত। এ দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত গণধর্ষণের দু’টি মামলা এমন, যেগুলো তাদের হিংস্রতা ও পাশবিকতার কারণে বিশ্বব্যাপী কুখ্যাতি লাভ করেছে। এর মধ্যে প্রথম মামলাটি হচ্ছে গুজরাটের অধিবাসী বিলকিস বানুর। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে দিল্লির নির্ভয়ার।

নির্ভয়ার খুনিদের ফাঁসিতে চড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিলকিস বানু বিশ বছর পরও ন্যায়বিচারের অনুসন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ২০০৮ সালে বিলকিসকে গণধর্ষণকারী ও গুজরাট গণহত্যার এ আসামিদের বেশ কষ্টের পর যাবজ্জীবন শাস্তি প্রদান করা হয়। সম্প্রতি গুজরাট সরকার তাদের ক্ষমা করে দিয়েছে এবং সেই ১১ জন ‘হিংস্র পশুকে’ মুক্ত করে দেয়া হয়। এরা ২০০২ সালের গণহত্যার সময় বিলকিস বানু ও তার পরিবারকে হিংস্রতা ও বর্বরতার শিকারে পরিণত করে। যে সময় বিলকিস বানুর ওপর পাশবিকতা চালানো হয়, ওই সময় তিনি পাঁচ মাসের গর্ভবতী ছিলেন। বিলকিসের ওপর হামলে পড়া নেকড়েরা তার পরিবারের আটজন ব্যক্তিসহ আরো ১৪ জন ব্যক্তিকে হত্যা করে। এই মানুষরূপী নেকড়েদের অপরাধ তার ধরন হিসেবে এতটাই মারাত্মক ছিল যে, তাদের কমপক্ষে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সরকার কর্তৃপক্ষ ন্যায়বিচারের পথে এতটাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় যে, এই আসামিদের যাবজ্জীবন শাস্তিও সেই সময় প্রদান করা হয়, যখন বিলকিস মামলার শুনানি গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্রে স্থানান্তর করা হয়।

মূলত বিলকিস বানু ধর্মীয় বিদ্বেষ, পাশবিকতা ও বর্বরতার এমন এক চলমান কাহিনী, যার কোনো নজির দেশে নেই। ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার সময় বিলকিসের প্রতিবেশীরাই তাকে গণধর্ষণ করেছিল। গুজরাট গণহত্যার এটা এমন এক কাহিনী ছিল, যার আর্তনাদ পুরো বিশ্বে শোনা গিয়েছিল। বিলকিস ও তার পরিবারের অপরাধ এটাই ছিল যে, তারা সবাই ছিলেন মুসলমান।
এ মামলার ১৪ আসামির যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছে। বাকি ১১ জন কারাগারে বন্দী ছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘আজাদী কে অমৃত মহোৎসব’ (স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব)কে উছিলা করে এদের ক্ষমা করে দেয়া হয়। এই হিংস্রদের মুক্তিতে বিলকিসের সব ক্ষত আবারো তাজা হয়ে গেছে এবং তিনি ২০ বছর আগের সেই সময়ে পৌঁছে গেছেন, যখন তার সাথে পাশবিকতা ও হিংস্রতার সব সীমা অতিক্রম করা হয়েছিল এবং তার চোখের সামনে তার তিন বছরের কন্যাকে আছাড় মেরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় একেবারে স্বাধীনতা দিবসে বিলকিস বানু যখন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলেন যে, তার মামলার সব আসামিকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, তখন তিনি নির্বাক হয়ে যান। কেননা তার মাথায় ৩ মার্চ, ২০০২ সালের সেই ঘটনাগুলো ফিল্মের মতো চলতে শুরু করে, যেগুলো আজো তার বেঁচে থাকাকে হারাম করে রেখেছে। তার মামলার আসামিদের মুক্তির পর তার চোখ দিয়ে অশ্রুসাগর বয়ে যায়। বাকহীনতা তাকে ঘিরে ধরে। অনেক কষ্টে দুই দিন পর তিনি কিছু বলার অবস্থায় ফিরে এলে তিনি তার উকিলের মাধ্যমে বলেন, ‘আমি জানতে চাই, কোনো নারীর জন্য ন্যায়বিচার এভাবে কেমন করে শেষ হতে পারে? আদালতের ওপর আমার আস্থা ছিল। আমি ধীরে ধীরে আমার ক্ষতগুলো নিয়ে বাঁচতে শিখছিলাম। ওই আসামিদের মুক্তি আরো একবার আমার কাছ থেকে আমার শান্তি ছিনিয়ে নিলো। ন্যায়বিচারের ওপর আমার বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে দিলো।’

বিলকিস বানুর স্বামী ইয়াকুব রাসূলের বক্তব্য, ‘আমরা বর্তমানে মারাত্মক বেদনাতুর অবস্থায় রয়েছি। আমাদের কাছে নিজেদের ব্যথা বর্ণনা করার জন্য শব্দ নেই। আসামিদের মুক্তি আমাদের ভেতর এক ভয়াবহ ভীতি সৃষ্টি করেছে।’ বিলকিস বানু ও তার স্বামীর সবচেয়ে বেশি চিন্তা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তারা যে পঞ্চাশ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন, সেটিকে তারা সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যাংকে জমা রেখেছেন। বিলকিস বানুর সবার বড় কন্যার বয়স ২০ বছর। বিলকিস বানু তাকে উকিল বানাতে চান। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বিলকিস বানুকে সরকারি চাকরি ও বাড়ি দেয়ার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। প্রাদেশিক সরকার বিলকিস বানুকে একটি দফতরে চাপরাসির চাকরি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি সেটি ফিরিয়ে দিয়ে তার স্বামীকে চাকরি দিতে বলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি।

বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, বিলকিস বানু গণধর্ষণের আসামিদের মুক্তি লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর সেই ভাষণের পরই কার্যকর করা হয়, যেখানে তিনি নারীর ইজ্জত-আব্রু ও সম্মান বজায় রাখার শপথ করেন। তিনি জনগণের কাছে আবেদন করেন, তারা যেন এমন কিছু না করার অঙ্গীকার করে, যার দ্বারা নারীর সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। তিনি এ কথা স্বীকার করেন যে, আমাদের কর্মকাণ্ডে ত্রুটি সৃষ্টি হয়েছে এবং আমরা কখনো কখনো নারীদের সম্ভ্রমহানি করছি। আমরা কি আমাদের কর্মকাণ্ড ও ভাগ্যলিপিকে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করতে পারি?’

প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের গুঞ্জরণ তখনো শেষ হয়নি, খোদ তারই রাজ্য গুজরাটে তারই দলের প্রশাসন এমন এক কাজ করে দেখাল, যা সারা দেশের নারীদের মাঝে ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে গুজরাট সরকারের এ পদক্ষেপ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এ দেশে এখন দাগি আসামি, খুনি, ব্যভিচারী ও হিংস্র পশুদেরই বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, প্রশাসনের যে প্যানেল এই হিংস্র পশুদের মুক্তির সুপারিশ করেছিল, সেখানে শুধু বিজেপিরই লোক যুক্ত ছিল। ওই প্যানেলে যুক্ত এক বিজেপি বিধায়কের বক্তব্য হচ্ছে, এই লোকদের এ জন্য মুক্তি দেয়া হয়েছে যে, এরা উচ্চ জাতের মানুষ। আর উচ্চ জাতের মানুষ অনেক ‘সভ্য’ হয়।

সবাই জানেন, ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার যেসব হৃদয়বিদারক কাহিনী তার হিংস্রতা ও পাশবিকতার কারণে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করে, তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও দৃশ্যমান ছিল বিলকিস বানু গণধর্ষণ ও হত্যা মামলা। এ জন্য বিলকিস বানু গুজরাট গণহত্যায় নির্যাতিতের সবচেয়ে বড় প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তৎকালীন গুজরাটের সরকার কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ যেহেতু হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজকারীদের সবচেয়ে বড় রক্ষক ছিল, তাই বিলকিস বানু মামলার প্রমাণ মুছে ফেলা থেকে নিয়ে আসামিদের বাঁচানো পর্যন্ত সেসব অবৈধ কর্মকাণ্ড করা হয়েছে, যেগুলোর কারণে কোনো সভ্য সমাজকে হাজারবার লজ্জিত হওয়া উচিত। এ কারণেই এ মামলাকে মুম্বাই হাইকোর্টে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখান থেকে আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। সেই হিংস্র নরপশুরা আজ মুক্ত হয়ে একে অপরকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে এবং তাদের ফুল দিয়ে বরণ করা হচ্ছে।

চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এক দিকে তো গুজরাট সরকার নিকৃষ্ট আসামিদের সাথে মহানুভতার আচরণ করছে, আবার অপর দিকে ওই ব্যক্তিদের ওপর বন্দিত্বের বাঁধন আরো শক্ত করা হচ্ছে, যাদের অক্লান্ত চেষ্টার কারণে গুজরাট গণহত্যার আসামিদের শাস্তি পর্যন্ত পৌঁছানো গেছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন সাহসী সমাজকর্মী তিস্তা শীতলভাড়, যিনি বর্তমানে কারাগারে বন্দী। মরহুম এহসান জাফরির বিধবা স্ত্রী জাকিয়্যা জাফরির আপিল সুপ্রিম কোর্ট থেকে খারিজ হওয়ার পর গুজরাট সরকার তিস্তা ও উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা আর বি শ্রী কুমারকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধের মামলা দায়ের করে দেয়। জুলুমের বিরোধিতাকারী অপর এক পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জিব ভাটও দীর্ঘ দিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। তার অপরাধ হচ্ছে, তিনি ২০০২ সালের গণহত্যায় সরকার কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততার প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন। গুজরাট সরকার বিলকিস বানু মামলার আসামিদের তার ক্ষমানীতির আওতায় মুক্ত করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, জুন মাসে কেন্দ্রীয় সরকার স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব উপলক্ষে কয়েদিদের মুক্তি সম্পর্কে বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছিল। তবে সেখানে ধর্ষণের আসামিদের মুক্ত করার কোনো সুযোগ ছিল না। তথাপি তাদের বড় অবদান রয়েছে বলে অভিহিত করে মুক্ত করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এরই ফলে ৬০০০-এরও বেশি মানবাধিকারের সদস্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে ওই আসামিদের শাস্তিতে প্রদত্ত ক্ষমা ও মুক্তি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। এখন দেখার বিষয়, সুপ্রির কোর্ট এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ২১ আগস্ট, ২০২২ এর উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com