আমরা টের পাচ্ছিলাম বেশ কিছু দিন ধরেই যে, বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে কেন? হুট করে বিদ্যুতের চলে যাওয়াকে লুকোচুরি খেলা বলে ভাবছিলাম। কিন্তু যখনই দেখলাম, প্রতিদিনই বিদ্যুৎ এই লুকোচুরি খেলা খেলছে, তখন বুঝলাম ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’।
সেই ‘কালা’ যে গ্যাস সঙ্কট সেটা তো অনেক পরে জানলাম। জনগণের অফিসারদের সময় কম, তাই তারা জানাতে পারেননি। নানাজনের কানকথায় জানতে পারছিলাম, এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করেও ব্যাপারটি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। কারণ, সেখানেও দাম বেড়েছে। কুয়েত ও আমিরাতের সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে বটে, তবে তাতে বাদ সাধছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। সেই সাথে রাশিয়ার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা (একে বলা হয় স্যাঙ্কশন)।
রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাপের মধ্যে রেখে যুদ্ধ থেকে তাকে সরানোর জন্য এটা করেছিল আমেরিকা। কিন্তু তাতে তেমন একটি চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। রাশিয়া কাবু হয়নি, মাথাও নোয়ায়নি। কিন্তু আমাদের মতো গরিব দেশ (মিথ্যা বললাম কি? সরকার অবশ্য মানে না যে আমরা গরিব, আমরা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের ক্লাবে বা তকমা পরে উঠে যাব নতুন তালিকায়। আমরা আর ‘লিস্ট ডেভেলপড’ বলে চিহ্নিত হবো না।) খোলা বাজার থেকেও এলএনজি কেনা হতো। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় তাও বন্ধ রেখেছে সরকার। সিদ্ধান্ত ভালো। কেননা, তাতে বিদ্যুতের দামও বেড়ে যেত পাওয়ার শক-এর মতো। তাই দাম না বাড়িয়ে, শক-ওয়েভ না নিয়ে বরং বিদ্যুতের চাহিদা কমানোর চিন্তা করেছে। সেই চাহিদা কমানোর জন্যই নানা পরিকল্পনা করে এই প্রথম জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদক, বিতরণ ও বিধি নির্মাতাদের উদযোগে বৈঠক হলো।
এ খাতের যিনি জিম্বাদার, সেই উপদেষ্টা ড. তৌফিক-এ -ইলাহী চৌধুরী জানিয়েছেন, কেন, কিভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা হবে। এই সাশ্রয়ের প্রধান উপায় হচ্ছে রাতে কোনো রকম আলোকসজ্জা না করা, দোকানপাট বন্ধ রাখা, সরকারি-বেসরকারি অফিস আওয়ার কমিয়ে আনা, মসজিদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসি ব্যবহার বন্ধ রাখা এবং বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে এমন সব খাতের সন্ধান করে তা বন্ধ করা। কাজটা খুবই সহজ, বোঝাই যায়। আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাচ্ছি সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও তার নাতিদীর্ঘ কর্মকর্তাদের। তারা যে চাপের মধ্যে আছেন এবং ঘুম থেকে উঠে বা জেগে সভা করেছেন, সঙ্কট নিরসনের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এর জন্য তারা অবশ্যই ধন্যবাদার্হ্য।
রাত ৮টার মধ্যে দেশের সব জায়গায়ই দোকানপাটের আলো নিভে যাবে, সাটার নেমে যাবে, তালা লাগবে দরোজায়, মসজিদে এসি চলবে না ৮টার পর নাকি সারা দিনই! সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতে এসির ব্যবহারও কমে আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরও কি বিদ্যুৎ সেক্টরে জনগণের অর্থের ভর্তুকি বন্ধ হবে? উৎপাদন করুক বা সরবরাহ করুক বা না করুক, রেন্টাল বিদ্যুতের দাম তো সরকার চুক্তি/বিধি অনুযায়ী দিয়ে যাবে। এই রেন্টাল খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করা, সরবরাহ না করলে দাম পরিশোধ না করার সিদ্ধান্ত নিলেই তো অনেক টাকা সাশ্রয় হবে। আর সেই টাকায় বাড়তি দামে এলএনজি স্পট মার্কেট থেকেও কেনা যাবে।
আবার এটাও করা যায় যে, যদি রেন্টাল খাত বন্ধ করে দিতে তাদের দেয়া প্রতি মাসে যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়, সেই টাকায় এলএনজি আমদানি করে বন্ধ রাখা সরকারের নিজস্ব প্লান্টগুলো চালু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সহজ ও স্বাভাবিক হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। কারণ ওই রেন্টাল বিদ্যুৎ তো লুটের জন্য খোলা হয়েছে। মাত্র দুই বছরের জন্য চুক্তি করেও আজ ১৪ বছর ধরে সেগুলো চালানো হচ্ছে। কোনো বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানিকে এত পায়ে কুড়াল মারা চুক্তি করার জন্য সরকারকে বাহবা দিয়ে তাদের মাথায় স্বর্ণের মুকুট পরানো যেতে পারে। সেখানে যে মধু আছে, তা সরকারের জিহ্বায় মিষ্টি লাগে।
এই ডিজিটাল দেশে বিদ্যুৎ পণ্য হিসেবে সব থেকে জরুরি পণ্য। সেই জরুরি পণ্য-প্রয়োজনকে সামনে রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ২০০৯ সালেই। কিন্তু সরকারের সেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি, মাত্র কয়েকটি বাদে বাকি কেন্দ্র এক বছর আগে পরিত্যক্ত ঘোষণা হয়েছে শত শত কোটি টাকা অপচয় করার পর। ওই সব ঘোষিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে যে ক’টির উৎপাদন সূচিত হয়েছে, তার অবদানেই তো আমরা চলছি। কয়েকটি উৎপাদনে যাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই। সেই কিছু দিন কবে আসবে তা আমাদের জানা নেই। কারিগরি বিষয় তো, তাই সংশ্লিষ্টরাও তেমনভাবে সিওরিটি দিতে পারেন না। তাই তারা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছেন। সেই বিদ্যুৎ আসবে আগামী সেপ্টেম্বরে। তখন আর আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে না। আমরা রেন্টাল দিয়ে যে ভর্তুকি গুনছি, বিদ্যুৎ আমদানি করে সেই ভর্তুকি আরো মোটা দাগে করব, তাতে আর এমন কী ক্ষতি? জনগণ বিদ্যুৎ পেলেই তো খুশি।
কিন্তু এর পরও প্রশ্ন থাকবে। তা হলো কেন দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণে ৫/৬/৭/৮//৯ বছর লাগছে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব কি দেয়া যাবে, যা যুক্তিসঙ্গত? আমরা কিন্তু পদ্মা সেতু করে ফেলেছি ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। ব্যয়টা একটু বেশি হয়েছে বটে, তবে তা এই বিশ্বমানের স্থাপনার জন্য এমন আর কী? ১০ হাজার এক কোটির প্রজেক্ট শেষে গিয়ে পৌঁছেছে ৩০ হাজার প্রায় ২০০ কোটি টাকায়।
করোনার দুই বছরও সেতু নির্মাণকাজ বন্ধ হয়নি, পুরোদমেই চলেছে। তিন কি চার বছরের মধ্যে সেতু নির্মাণ শেষ করার চুক্তি থাকলেও, ব্যর্থ-নির্মাতা ঠিকাদারের ওপর কোনো চাপ দেয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রাক্কলিত ব্যয় ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে সেই ঠিকাদারকে ফাইন করাই যেখানে বিধিবদ্ধ রীতি, সেখানে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে টাইম ও ব্যয় বাড়িয়ে দিয়ে।
প্রজেক্টটা যে জাতিকে দেখিয়ে দেয়ার ফসল সেটা তো আমরা জানি। আমরাই, আমাদের টাকায়ই করেছি… ইত্যাদি রাজনৈতিক ধ্বনি জারি রেখে জাতিকে বোঝানো যাবে না, জনগণের টাকা ঠিকাদারদের ব্যর্থতা ঢাকা দিতে নাকি নিজেদের পকেট ভারী করতে সেটা করা হয়েছে। জনগণ যখন প্রত্যেক খাতের অনুপুঙ্খ হিসাব চাইবে, তখন জবাবদিহি করতে হবেই! কেননা, সরকার তো জোরগলায় বলে তারা গণতান্ত্রিক সরকার! বুঝবে যখন দিন ঘনিয়ে আসবে। বিদ্যুতের বিষয়টিও সে-রকমই হবে।
বিদ্যুৎ চুরি একটি মহৎ কাজ। এটা জারি আছে বিদ্যুৎকর্মী ও কর্তাদের মনে। ভোক্তাদের ওপর বাড়তি বিল চাপিয়ে দিয়ে চুরি করে সেই টাকা। আর যারা প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তাদের বেশির ভাগই ঘুষ দিয়ে অনেক কম বা নামমাত্র বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করে রেখেছেন কর্মী/কর্তাদের সহযোগিতায়। এমনকি এদের অনেকেরই রয়েছে নকল নামে চোরাই বা বেনামি নামে সংযোগ। তাদের চোরাই সংযোগ কখনোই বন্ধ হয় না। চোরাই নামে তো আর বিল হয় না, হতে পারে না। এই চোরাই সংযোগও বন্ধ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৌফিক-এ-ইলাহী। এই সিদ্ধান্তকে করতালিতে মুখর করতে চাই। কারণ দুইভাবে এই করতালি ব্যবহার হবে।
এক. তিনি চোরাই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন এই আশায়। (যদিও তার উপদেষ্টাকালের বয়স কম হয়নি, কিন্তু এক ওয়াট বিদ্যুতের অপচয় ও চুরি রোধ করেননি, করতে পারেননি) আরেকটি করতালি পাবেন, দু’-একটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেখাবেন যে তারা সফল হয়েছেন। সেই সাফল্যের জন্য আরেকবার করতালি দেবো। কিন্তু বাস্তবে এগুলো হবে না। উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ থেকে ২০ শতাংশই এসব শিল্প সেক্টরের চোরাই সংযোগে ব্যবহৃত হয়। ওই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা গেলে বিদ্যমান সঙ্কট থাকবে না, থাকতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, শিল্প সেক্টরে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়ে আছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তারা সেগুলো পরিশোধ করেন না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে ওই সেক্টরে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করেন না বিদ্যুৎ উৎপাদক ও বিক্রেতারা। এতে তারাও ঘুষের অংশীদার। লুটেরা সংস্কৃতির এটাও এক শাখা। এসব শাখার কথা সবাই জানে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। নিলে, তারা (রাজনৈতিক সরকার) মনে করে আগামী নির্বাচনী ব্যয় মেটানোর টাকা কোথায় পাবেন? পেছন থেকে, চোরাই পথে এরাই তো শত শত কোটি টাকা রাজনীতিকদের দেন। একে কি আমরা ঘুষ বলতে পারি? কভি নেহি। বলব ক্ষমতারোহণের সিঁড়ি নির্মাণের টাকা।
সরকারি দফতরের কর্তাদের অফিসের এসির ব্যবহার কি বন্ধ করা হবে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর? নাকি কেবল মহানগরের মধ্যবিত্তবানদের এসিগুলো বন্ধ হবে? আমরা জানি না।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম সিদ্ধান্তটি খুবই ভালো। অনেক কারণ থাকলেও, যারা এই সুযোগটি পাবেন তারা কম্পিউটার ব্যবহারে পারদর্শী হবেন। দ্বিতীয়ত মহানগরের যাতায়াতের চরম দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবেন। তৃতীয়ত তাদের ব্যয় সাশ্রয় হবে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে আসবে, চাপ কম হবে। জ্বালানি সাশ্রয় হবে। আরো বহু কিছু হতে পারে।
তবে, এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করার শক্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সরকারের আছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। কেননা, তারা ভোটের রাজনীতি ও সরকারের গদির মোহ ত্যাগী নন। তারা যদি জনগণের কল্যাণের কথা ভাবতেন, তাহলে অবশ্যই সরকারি ব্যয় সঙ্কোচন করে সাশ্রয়ী হতেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ নেয়ার ভিত্তি ধরে বাজেট প্রণয়ন করা সহজ। কিন্তু ওই সহজ পথের মাধ্যমে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তাদের রাজনৈতিক বুলি বুলেটগতি লাভ করলেও অর্থনৈতিক শক্তি দিন দিন কমে আসছে, যা শঙ্কা সৃষ্টি করছে মনে। এই শঙ্কা দিন দিনই ঘনীভূত হচ্ছে। এর সীমা হাত ছাড়া হয়ে গেলে তা মোকাবেলা করা কঠিন হবে।